দিলীপ বেঙ্গসরকর স্বগতোক্তির মতো বললেন, “স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি! নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না।”
রাত সাড়ে সাতটা। স্মারক বক্তৃতা শেষ হয়ে গিয়েছে এক ঘণ্টারও ওপর। কিন্তু উল্টো দিকের রাস্তার ওপর লোকে এমন সার দিয়ে দাঁড়িয়ে যে, স্থানীয় ট্র্যাফিক ভেঙে পড়ার উপক্রম। মুম্বই জিমখানার উল্টো দিকে ফ্যাশন স্ট্রিটে সার দিয়ে সব দোকান। মনে হচ্ছে সেখানে ঝাঁপ বন্ধ করে সব দোকানদার চলে এসেছে। সামনে পার্ক করা গাড়িটা কার্যত অবরুদ্ধ। যা দেখেটেখে বেঙ্গসরকর আরও বলে যাচ্ছেন, “অবিশ্বাস্য। মুম্বইতে এ জিনিস ভাই গাওস্কররের জন্যও হয় না।” নির্বাচক কমিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান এ বার ভিড়ের ধাক্কা আর গুঁতোগুঁতি আরও বেড়ে গেল দেখে দ্রুত নিজের গাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে ঢুকে পড়লেন। গুঁতোগুঁতি বেড়ে গিয়েছে কারণ ততক্ষণে হোটেলে ফেরার জন্য যে গাড়ির সন্ধানে বেরিয়ে এসেছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ভারতের যে মাঠে এ দেশে প্রথম টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে এর আগে কখনও আসেননি সৌরভ। আর এসে আবিষ্কার করলেন, অবসরের চার বছর বাদেও ভারতের তথাকথিত অনাহুজুগে, পেশাদার বাণিজ্যনগরী কী পরিমাণ আবেগ লুকিয়ে রেখেছে তাঁর জন্য!
স্মারক বক্তৃতা মানে অনিবার্য ভাবে গম্ভীর একটা ব্যাপার। বক্তা ফর্ম্যাল পোশাক পরবেন। টাইমে আসবেন। অনুষ্ঠানের একটা ফর্ম্যাল মেজাজ থাকবে। যুগ-যুগান্ত ধরে তাই হয়ে এসেছে। তা এখানে প্রথম সারিতে বসা মাধব মন্ত্রী, বাপু নাদকার্নি, অজিত ওয়াড়েকর এবং বেঙ্গসরকরদেরও আধ ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করিয়ে সৌরভ ঢুকলেন। টাই বা ব্লেজারের কোনও কাহিনি নেই। ডিজাইনার ফুলশার্ট। হাতে অবশ্য একটা লিখিত বক্তৃতা আছে। মিনিট পাঁচেক সেটা থেকে পড়লেনও। তার পর যেন নিজেই বোর হয়ে পাতা বন্ধ করে দিলেন। এটা নিশ্চয়ই পৃথিবীর সংক্ষিপ্ততম স্মারক বক্তৃতা। অনুষ্ঠান শেষে আক্ষেপও করলেন দস্তুরমতো। “জীবনে প্রথম একটা বক্তৃতা তৈরি করে এনেও সেটা পড়া হল না। কী যে হল আমার!”
অনুষ্ঠানের আয়োজক রাজদীপ সরদেশাই অবশ্য যথোচিত সান্ত্বনা দিলেন তাঁর আমন্ত্রিত বক্তাকে, “এ জন্যই তুমি রাহুল দ্রাবিড় নও। সৌরভ! রাহুল হলে যা লিখে এনেছে সেটাই দাঁড়ি-সেমিকোলন সমেত পড়ত। এক লাইনও বাইরে যেত না। আর তুমি কিনা দ্রুত প্রশ্নোত্তরে চলে গেলে! দুর্ধর্ষ সব উত্তরে মাতিয়ে দিলে!”
এমনিতে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যাঁকে স্মরণ করা হল, তাঁর সঙ্গে আমন্ত্রিত বক্তার একগুচ্ছ মিল রয়েছে। দু’জনেই মিডল অর্ডার প্লেয়ার। দু’জনেরই টেস্ট গড় কাছাকাছি। ৩৯.২৩ আর ৪২.১৭। দু’জনের কেউই দক্ষ ফিল্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। আর দু’জনেই ভারতীয় ক্রিকেটে নবজন্মদাতা হিসেবে খ্যাত!
তিনি—দিলীপ নারায়ণ সরদেশাই খ্যাত ভারতীয় ক্রিকেটে রেনেসাঁ আবাহনের জন্য।
তিনি—সৌরভ চণ্ডীদাস গঙ্গোপাধ্যায় খ্যাত ভারতীয় ক্রিকেট অধিনায়কত্বে রেনেসাঁ আবাহনের জন্য।
পাঁচ বছর আগে মারা যাওয়া সরদেশাইয়ের সামান্য পরিচিতরাও জানেন, তিনি কেমন আমুদে মানুষ ছিলেন। পোডিয়ামের পিছনেও তো আজ বড় করে ফ্লেক্স লাগানো‘হি লাভড ক্রিকেট অ্যাজ মাচ অ্যাজ হি লাভড লাইফ।’ এর আগে তিনটে সরদেশাই স্মারক বক্তৃতা দিয়েছেন যথাক্রমে গাওস্কর, বেদী আর কপিল। অথচ জীবিত থাকলে আজকেরটা বোধহয় সরদেশাই সবচেয়ে বেশি উপভোগ করতেন। বিজ্ঞাপনী ভাষায় ‘ফুলস্কেল এন্টারটেনমেন্ট।’ সৌরভ কোনও আগলই যে রাখেননি। সময় সময় মনে হচ্ছিল, পাড়ায় আড্ডা দিচ্ছেন।
জিজ্ঞেস করা হল, আপনি নিজে নাকি এখন কোচ হতে চান। তা ভারতীয় দলে যাঁর কোচিংয়ে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন সেই গ্রেগ চ্যাপেলের কোন একটা গুণ আপনি অনুসরণ করবেন? কোন একটা গুণ আপনি বর্জন করবেন?
সৌরভ বললেন, “গ্রেগ ব্যাটিং কোচ হিসেবে বিশ্লেষণে খুব ভাল। ওর ব্যাখ্যা করার চমৎকার দিকটা অনুসরণ করব। আর বর্জন? এতগুলো আছে। সেখান থেকে বেছে মাত্র একটা করা—কী কঠিন কাজ” শুনে গোটা হল হেসে গড়িয়ে পড়ল। “হ্যাঁ, গ্রেগের মতো আমি ক্যাপ্টেনের ওপর ফরমান জারি করব না। তাকে স্বাধীন ভাবে চলতে দেব।” এর পর আবার প্রচণ্ড হাসি শুরু হয়ে গেল যখন ভারতের দুই অধিনায়ককে বিস্ফারিত করে দিয়ে সৌরভ ঘোষণা করে দিলেন, “ভারত অধিনায়কত্ব করা আইপিএলে ফ্র্যাঞ্চাইজির নেতৃত্ব দেওয়ার চেয়ে অনেক সহজ।” বললেন, “প্রায় ছ’বছর আমি দেশের অধিনায়কত্ব করেছি। কই, একবারের জন্যও তো বোর্ড প্রেসিডেন্ট বা নির্বাচক প্রধান আমাকে জানতে চাননি কেন অমুকটা করলে? অথচ আইপিএলে ম্যাচের আগে বা পরে বাধ্যতামূলক জবাবদিহি করতে হয়। ফোন বন্ধ করেও নিস্তার পাইনি। মালিকেরা ঠিক কাউকে না কাউকে দিয়ে তলব করেছে, কেন অশোক দিন্দাকে ওই ভাইটাল ওভারটায় তুমি স্লোয়ার দিতে বললে না?” |
ভিড়ের মধ্য থেকে জনৈক দর্শক জিজ্ঞেস করলেন, অন্যের কথায় কান দেবেন না। আইপিএল সিক্স কিন্তু খেলতেই হবে। সৌরভ বললেন, “নিশ্চয়ই। যদি আপনি আমার হয়ে ফিল্ডিংটা করে দেন।” আবার হাসি এবং হাততালি। জানালেন, সেই ১৯৮৭ সালে এমআরএফ পেস অ্যাকাডেমিতে তিনি আর সচিন তেন্ডুলকর কী ভাবে পেসার হিসেবে ঢোকার জন্য ডেনিস লিলির মন জয়ের ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন। চেন্নাইতে তিনি আর সচিন এক রুমে ছিলেন। কিন্তু একে অপরের সঙ্গে আলাপই ছিল না। এর পর থার্ড ডে-তে দু’জনকে ডেকেই লিলি বলে দেন, তোমরা বরং ব্যাটিংয়ে মন দিলে ভাল করবে। সৌরভ বললেন, “লিলির চোখ। ব্যাটসম্যান সচিনকে সেই কবে প্রথম চিনেছিল!” শোনামাত্র আবার বিশাল হাততালি দিল তেন্ডুলকরের শহর।
এ বার চ্যানেলের পোড়খাওয়া এক সাংবাদিক বাউন্সার দিলেন, গত ক’দিন ধরে আপনি কী করে সচিনের পক্ষে সওয়াল করছেন? শরীরবিজ্ঞানকে যে জিনিয়াসেরও মানতে হবে, এই বাস্তব অন্তত আপনি কেন বুঝবেন না সৌরভ! জবাবে সচিনের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ওপেনিং পার্টনার বললেন, “তার কারণ টেস্টে ওর নড়াচড়ায় আমি কোনও মন্থরতা দেখিনি। এ রকম আউট সচিন আগেও হয়েছে। আমার বিশ্বাস, ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় টিম সামনে পেলে ওর মস্তানিটা ঠিক আবার বেরিয়ে আসবে। তা ছাড়া সচিনকে আমি চিনি। এই যে ওর খেলা নিয়ে একটা অশ্রদ্ধামূলক আলোচনা হচ্ছে এটা ওর কাছে অসহ্য হবে। আর তার যোগ্য জবাব দিতে সচিন তেড়েফুঁড়ে নামবেই।” শেষ করতে না করতেই স্তূপীকৃত হাততালি।
এত ভিড় সৌরভের বক্তৃতা শুনতে যে অন্তত শ’খানেক লোককে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল। উদ্যোক্তারা বোধহয় ভাবেননি চার বছর আগে অবসৃত কারও জন্য মিডিয়া এবং মানুষ এত হুড়মুড়িয়ে আসতে পারে। ভিড়ের মধ্যে দেখলাম সৌরভের প্রাক্তন ম্যানেজার পারসেপ্ট কর্তা শৈলেন্দ্র সিংহকেও। মুম্বইয়ের আদালতে গত পাঁচ বছর ধরে কোটি টাকার বিষাক্ত আইনি লড়াই চলছে সৌরভ আর পারসেপ্ট-এর। তিনিও হাজির কেন?
একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল বিতর্কিত কিছু ফার্স্টহ্যান্ড শোনার লোভে। তাঁর সতীর্থ কাম বন্ধু আলঙ্কারিক বক্তৃতায় সুখ্যাত। দশ মাস আগে অ্যাডিলেডে ব্র্যাডম্যান স্মারক বক্তৃতা এত ভাল দেওয়ার পর তো বক্তা হিসেবে রাহুল দ্রাবিড়ের প্রসিদ্ধি এখন আন্তর্জাতিক স্তরে।
কিন্তু আকর্ষণের চৌম্বকক্ষেত্রে সৌরভ তাঁরও আগে। সচিনের শহর দেখাল, আগে আঁচ করা যায় না বিতর্কিত কোন সিন্দুকের ঝাঁপি কখন দুম করে খুলে দেবেনএটাই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় টিআরপি! |