বেহালার প্যারিসপাড়ার হত্যাকাণ্ডে আততায়ী ক’জন ছিল, সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নন গোয়েন্দারা। তবে, চারটি খুন যে একই হাতের কাজ, ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে। আরও বলা হয়েছে, প্রত্যেককেই খুন করা হয়েছে ডান হাতে।
পাশাপাশি, আঘাতের ধরন দেখে গোয়েন্দাদের ধারণা, খুনগুলি আনাড়ি কারও হাতে হয়নি। কারণ, নিহত চার জনেরই গলায় পোঁচের পর পোঁচ দিয়ে ‘ক্যারোটিড আর্টারি’ এবং ‘জুগুলার ভেন’ কেটে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, সেগুলি কাটলে যে মৃত্যু নিশ্চিত, তা আততায়ীর জানা ছিল।
আবার আততায়ী যে আনাড়ি নয়, এমন ধারণা আরও পোক্ত হয়েছে ময়না-তদন্তের রিপোর্টে। কারণ, পরপর চারটি খুন করার মতো মানসিক জোর অপেশাদার কারও থাকার কথা নয়। গোয়েন্দাদের অনুমান, আততায়ী সম্ভবত ছিল কোনও ভাড়াটে খুনি।
একসঙ্গে চার জনের গলার নলি কেটে খুনের এ রকম ঘটনা সাম্প্রতিক কালে কবে হয়েছে, তা মনে করতে পারছেন না কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা। অনেকের মন্তব্য, এ যেন সেই ‘জ্যাক দ্য রিপার’-এর মতো। শুধু ধারাবাহিক খুনের বদলে এ ক্ষেত্রে খুন হয়েছে একই সঙ্গে।
নিহতদের গলার নলি যে ভাবে কাটা হয়েছে, তাতে গোয়েন্দারা প্রথম থেকেই সন্দেহ করছিলেন, চারটি খুন হয়েছে এক হাতেই। ময়না-তদন্তেও জানা গিয়েছে, নিহত চার জনেরই গলার ‘ক্যারোটিড আর্টারি’ এবং ‘জুগুলার ভেন’ কেটে দেওয়ার ফলে ঘটনাস্থলেই সকলের মৃত্যু হয়। |
স্মৃতির পাতায় জ্যাক |
১৮৮৮ সালে অগস্ট থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায় পাঁচ জন মহিলার গলার নলি কাটা, পেট কাটা মৃতদেহ পাওয়া যায়। পাঁচটির মধ্যে তিনটি খুনই হয়েছিল সেপ্টেম্বরে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই খুনের কায়দা এক। গলার নলিতে বা ঘাড়ে দুই পোঁচ। দু’ফাঁক হওয়া পেট থেকে লিভার বা কিডনির মতো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বার করে নেওয়া। মহারানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বে সে দিন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড খুনিকে ধরতে পারেনি। তখনকার সংবাদমাধ্যম তাই অচেনা অপরাধীকে একটি নাম দেয়। প্রচলিত ধারণা অনুসারে, এই নামের উৎস একটি চিঠি। যে চিঠিতে পত্রলেখক নিজেকে আততায়ী বলে দাবি করেন। তবে চিঠিটি ভুয়ো বলেই অধিকাংশের বিশ্বাস।
তবে, উৎস যা-ই হোক, ১২৪ বছর পেরিয়ে আজও লোকে শিউরে ওঠে সেই নামে। প্রমাণ? মাত্র ছ’বছর আগে ‘বিবিসি হিস্ট্রি’র পাঠকদের ভোটে সব চেয়ে কুখ্যাত ব্রিটিশ: জ্যাক দ্য রিপার। |
* ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের ধারণা, এমনই দেখতে ছিল জ্যাক। |
|
কেউই বেশি নড়াচড়া করার সুযোগ পাননি। গলার নলি কাটার ধরন দেখে কলকাতা পুলিশের প্রবীণ অফিসারদের অনুমান, খুনের আগে সকলকেই হয়তো কাবু করে ফেলা হয়। এই কারণেই খুনের সময় চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দও প্রতিবেশীরা পাননি। তবে খুনগুলি এক হাতে হয়ে থাকলেও দুষ্কৃতীরা সংখ্যায় ক’জন ছিল, তা নিয়ে এখনও ধন্দে গোয়েন্দারা।
খুন করার জন্য গলার নলি কাটার পরিকল্পনা করা হয়েছিল কেন?
গোয়েন্দাদের বক্তব্য, পাড়ার মধ্যে গুলি করে খুন করলে আওয়াজে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সে পথে যায়নি আততায়ীরা। গুলি করে খুন করতে না পারলে খুনিরা সাধারণ ভাবে এ রকম পরিস্থিতিতে গলার নলি কেটে খুনের সিদ্ধান্তই নিয়ে থাকে বলে মনে করছেন গোয়েন্দা-কর্তারা। চিকিৎসকেরা জানান, খুনের মামলায় যে সব দেহ ময়না-তদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়, তার একটা বড় অংশই গলার নলি কেটে খুন।
গলার নলি কাটা হলে কী ভাবে মারা যায় ‘শিকার’?
শল্যচিকিৎসকেরা জানান, গলার দু’পাশে যে অংশ দপদপ করে, সেখানেই রয়েছে ক্যারোটিড আর্টারি এবং জুগুলার ভেন। পেশাদার খুনিরা একটি ব্লেড চালিয়েও গলার নলি কেটে খুন করে ফেলতে পারে। তিন-চার ইঞ্চি টানা কেটে দিতে পারলেই মৃত্যু অনিবার্য। কাউকে মেরে ফেলার জন্য এই ক্ষত খুব বেশি গভীর হওয়ারও দরকার পড়ে না বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। ওই চিকিৎসকদের ব্যাখ্যা, ক্যারোটিড আর্টারি ও জুগুলার ভেন কেটে ফেলতে পারলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে শুরু করে। খুব তাড়াতাড়ি প্রচুর রক্ত বেরিয়ে যাওয়ায় মানুষ নেতিয়ে পড়ে। হাত-পা ছোড়ার শক্তিও কমে যায়। ফলে নলি কাটার মিনিটখানেকের মধ্যেই মৃত্যু হয়।
গলার নলি কেটে আত্মহত্যা করা কি সম্ভব? চিকিৎসকেরা জানান, এ ভাবে আত্মহত্যা করা কার্যত অসম্ভব। কারণ, গলার নলি কাটতে শুরু করলেই পেশি কাটার ব্যথায় ও রক্তক্ষরণের ফলে নিজের হাত কিছুক্ষণেই নিস্তেজ হয়ে আসবে। তাই চাপ দিয়ে আর কাটতে পারা যাবে না। একই সঙ্গে শুরু হবে শ্বাসকষ্টও। তাই এ ভাবে আত্মহত্যা সম্ভব নয় বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। |