আগে দক্ষিণমুখো হয়ে বসতেন। টেবিল-চেয়ারের অবস্থান বদলে এখন উত্তরমুখী। দেওয়াল পাল্টেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। সরানো হয়েছে ঘরের টিভিও। বাস্তুশাস্ত্রবিদের পরামর্শে এ ভাবেই মহাকরণে নিজের ঘরের ভোল পাল্টে ফেলেছেন মন্ত্রী অরূপ রায়। মঙ্গল হবে এই বিশ্বাসে।
দোকান-ব্যবসা, কলকারখানা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাস্তুশাস্ত্রের প্রয়োগ অনেক দিনই প্রচলিত। বাস্তুশাস্ত্র ভারতের প্রাচীন নিজস্ব বিদ্যা হলেও এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিনা ফেং সুই। সাধারণ মানুষও এতে আকৃষ্ট হচ্ছেন। এ বারে সরকারি অফিস ও মন্ত্রালয়েও ঢুকে পড়ল বাস্তু।
মহাকরণে বাস্তুশাস্ত্রের প্রবেশ অবশ্য এই প্রথম নয়। বর্তমান বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত বাম আমলে মুখ্যসচিব ছিলেন দীর্ঘদিন। মুখ্যসচিব হওয়ার পরে বাস্তুশাস্ত্র মতে ঘরে চেয়ার-টেবিলের অবস্থান পাল্টেছিলেন তিনি। বদল হয়েছিল দরজাও। যাঁর পরামর্শে ওই সব পরিবর্তন হয়েছিল, সেই বাস্তুশাস্ত্রবিদ পিঙ্কি কপূর বলেন, আগে এ বিষয়ে মূলত ব্যবসায়ীরাই আগ্রহী ছিলেন। এখন সাধারণ মানুষও এগিয়ে আসছেন। |
বাম আমলে আমলার ঘরে বাস্তুশাস্ত্র ঢুকলেও মন্ত্রীদের ঘরে তার প্রবেশের কথা শোনা যায়নি। মহাকরণে সেই ‘পরিবর্তন’ কার্যত খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। ভোটে জেতার পরেই মমতার অভিমত জেনে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর ঘর বাস্তুশাস্ত্র মেনে ঢেলে সাজা হয়। তাঁর কাজের টেবিল করা হয় অশ্বক্ষুরাকৃতি, যা বাস্তুশাস্ত্র মতে মঙ্গলদায়ক।
তার পর কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায়। তাঁর কথায়, “আমাকে উত্তরমুখী হয়ে বসার পরামর্শ দেন এক বাস্তুশাস্ত্রবিদ। তাই বসার ব্যবস্থায় কিছু অদলবদল করেছি।” তবে সমস্যা এখনও থেকে গিয়েছে বাথরুম নিয়ে। মন্ত্রীর বক্তব্য, “পুজোর ছুটিতে বাথরুমটিকে উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে সরিয়ে উত্তর-পশ্চিম কোণে নিয়ে যেতে চাই।” বাস্তু মেনে মহাকরণে নিজের ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে একটা গণেশ বসিয়েছেন আবাসনমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও। তাঁর যুক্তি, “ওটা ভগবানের কোণ। বহু কাল আগে কংগ্রেস আমলে এই ঘরে বসতেন সুব্রতদা (তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়)। একটা বিশেষ ঘটনার পর ভূতের ভয়ে তিনি ঘরটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ঘরের অবস্থানটা ভাল। গণেশের মাধ্যমে আমি বাস্তুর প্রয়োগই ঘটালাম।”
এখনকার পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, “বাস্তু একটা বিজ্ঞান, তা অস্বীকার করি না। তবে, এর প্রয়োগে আমার আগ্রহ নেই।” মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও বলেন, “বাস্তুর প্রয়োগ নিয়ে কিছু ভাবছি না।” পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের কথায়, “আমি বাস্তু মানি। যদিও সেটা মেনে মহাকরণের ঘরের বা বসার অবস্থান বদলের কথা মাথায় আসেনি।” |
তৃণমূলের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বাস্তুর সাহায্য নিয়েছেন, কিন্তু বিধানসভায় নিজের ঘর সাজাতে নয়। বাস্তুশাস্ত্র মেনে তিনি বদলেছেন ভবানীপুরে নিজের বাড়ির রঙ। তাঁর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর সুনজরে থাকার কথা ভেবে নয়, আমার স্ত্রী অনেক দিন ধরে অসুস্থ। বাড়ির অন্যান্য ঘরের রঙ ছেলে পছন্দ করলেও ওর মায়ের ঘরের রঙ ঠিক করা হয়েছে বাস্তু মেনে।”
ভারতীয় পুরাণে রয়েছে বাস্তুশাস্ত্রের উৎস-কাহিনি। বলা হয়েছে, অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে কোণঠাসা দেবতারা নিজেদের তেজ দিয়ে বাস্তুদেবের জন্ম দেন। অসুরদের পরাস্ত করার পরে এই বাস্তুদেবই পৃথিবীকে ধারণ করেন। রাজ্য সরকারের অতিরিক্ত মুখ্য স্থপতি মলি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “প্রাচীন ভারতে বাড়ি-ঘর তৈরি হত বাস্তুশাস্ত্র মেনে। পরে জমি-জায়গার অভাব হয়, তাই কম জায়গায় আধুনিক বাড়ি করতে গিয়ে বাস্তুশাস্ত্র মানা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আবার বাস্তু নিয়ে চর্চা বেড়েছে।”
সরকারি বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে অবশ্য বাস্তুশাস্ত্র প্রয়োগের কোনও সুযোগ নেই। যদিও মলিদেবী জানাচ্ছেন, রাজ্য সরকারের স্থপতিবিদ্যা বিভাগের স্থপতিরা (তাঁরাই সরকারি সমস্ত বাড়ির নকশা তৈরি করেন) কার্যক্ষেত্রে যে ভাবে নকশা তৈরি করেন, তার সঙ্গে বাস্তুশাস্ত্রের পুরোপুরি মিল রয়েছে। তাঁর কথায়, “স্থাপত্যবিদ্যায়ও বাস্তুশাস্ত্রের মতো উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম কোণকে গুরুত্ব দিয়ে বাড়ির নকশা তৈরি করা হয়। বাস্তুশাস্ত্রের মতোই বাড়ি তৈরির সময় আলো-হাওয়ার প্রবেশ ও প্রবাহে জোর দেওয়া হয়। বসার ঘর, শোওয়ার ঘর, রান্নাঘর, টয়লেট, পুজোর ঘরের নকশা তৈরি হয় দিক বিবেচনা করে।”
ইংরেজ আমলে কার্যত বাস্তুশাস্ত্র মেনেই দক্ষিণমুখী করে তৈরি হয়েছিল মহাকরণ। সামনের লালদিঘি থাকাটা স্থপতিবিদ্যার মূলনীতি, যা বাস্তুশাস্ত্রেরও মূলভিত্তি। মহাকরণে মূল নকশায় ঘরের মধ্যে বাথরুম ছিল না। পরে বহু ক্ষেত্রে নকশা বদলেছে। মহাকরণের ভিতরের ফাঁকা জমিতে তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি বাড়ি। যা স্থাপত্যবিদ্যার নীতিবিরুদ্ধ। ফলে মহাকরণের খোলামেলা ভাবটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বাড়ি গরম হয়ে পড়ছে। হাওয়া খেলছে না। |