পরিবারের বিবাদ না ব্যবসায় শত্রুতা, কারণ খুঁজছে পুলিশ
বেধড়ক মারে কাবু করে গলায় পোঁচ
প্রাণপণ বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন তিন জন। কিন্তু খুব বেশি ক্ষণ খুনিদের সঙ্গে যুঝতে পারেননি। সেই ধস্তাধস্তির চিহ্ন রয়ে গিয়েছে বেহালায় বীরেন রায় রোড (পশ্চিম)-এ প্যারিসপাড়ার বাড়িতে। ৮০ বছরের অসুস্থ ও শয্যাশায়ী বৃদ্ধাকে অবশ্য মারধরের প্রয়োজন হয়নি।
ময়নাতদন্ত থেকে প্রাথমিক ভাবে এই তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এর থেকে তাঁদের অনুমান, আততায়ী একাধিক। তাই তিন জনকে কাবু করতে তাদের সমস্যা হয়নি। কী ভাবে? ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, মাথায় আঘাত রয়েছে দীপক ভট্টাচার্য, আয়া ময়না রায় ও পরিচারিকা অণিমা মণ্ডলের। অশীতিপর গৌরীদেবীর ক্ষেত্রে অবশ্য এমন কোনও চিহ্ন মেলেনি। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, দীপক, ময়না এবং অণিমাকে বেধড়ক মারধর করা হয়। তার পর ভারী কোনও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কেটে ফেলা হয় গলার নলি। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলে এই হত্যালীলা। ময়নাতদন্তে নিহত চার জনের গলা প্রায় তিন ইঞ্চি গভীর ভাবে ক্ষতের চিহ্ন মিলেছে।
যে ভাবে চার জনকে খুন এবং প্রমাণ লোপের চেষ্টা করা হয়েছে, তা থেকে তদন্তকারীদের ধারণা, আততায়ীরা আনাড়ি নয়। রীতিমতো ছক কষেই এই খুন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মুখে হওয়া এই খুনের ঘটনায় অবশ্য শুক্রবার রাত পর্যন্ত কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “খুনের ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার বা আটক করা হয়নি। তবে কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।”
ময়নাতদন্তে জানা গিয়েছে, সবচেয়ে বেশি ধস্তাধস্তির চিহ্ন ছিল ময়না রায়ের শরীরে। বছর পঞ্চাশের ময়নাকে ভারী কিছু দিয়ে একাধিক বার আঘাত করা হয়েছে। তদন্তকারীদের ধারণা, আততায়ীদের সঙ্গে রীতিমতো লড়াই চালিয়েছেন তিনি। ৫২ বছরের দীপকবাবু ও ২৮ বছরের অণিমার মাথার পিছনেও আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
সওয়াল ১০
কেন খুন
কাকে খুন করতে এসেছিল খুনিরা
আততায়ী কত জন
কী অস্ত্রে খুন
সেই অস্ত্র কোথায়
একতলায় দু’টি দেহের পাশে রক্তমাখা গামছা কেন
আততায়ীরা ঢুকল কী ভাবে
তারা কি নিহতদের পরিচিত
উপরের ঘরে তিনটি ও একতলায় দু’টি চায়ের কাপ কেন
কেন হত্যাকাণ্ডে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগল
রহস্যে ঘেরা হত্যাপুরী
বিস্তারিত...
খুনের পরে প্রমাণ লোপাট এবং পুলিশকে ভুল পথে চালিত করার ক্ষেত্রেও চেষ্টা চালিয়েছে আততায়ীরা। খুনের অস্ত্র এখনও মেলেনি। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, বাড়ির দোতলায় পাশাপাশি যে দু’টি ঘর থেকে গৌরীদেবী এবং দীপকবাবুর দেহ মিলেছে, সেগুলি লাগোয়া একটি বেসিনে রক্তমাখা হাত ধুয়ে ফেলে আততায়ীরা। তবে অণিমা এবং ময়নার দেহের কাছ থেকে দু’টি রক্তমাখা গামছাও উদ্ধার করেছে পুলিশ। খুনিরা তাড়াহুড়োয় সেগুলি ফেলে গিয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
গোয়েন্দারা বলছেন, এই ঘটনার সঙ্গে ভট্টাচার্য পরিবারের কোনও পরিচিত ব্যক্তির যোগ থাকারই সম্ভাবনা বেশি। তিনিই সম্ভবত খুনিদের ভাড়া করেছিলেন। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “দীপকবাবুদের ঘরের একাধিক আলমারি খোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। যা থেকে প্রাথমিক ভাবে মনে হয়, লুঠ করতে এসেই খুন করা হয়েছে। কিন্তু গৌরীদেবীর হাতের সোনার বালা নিয়ে যায়নি দুষ্কৃতীরা।” এ থেকে পুলিশ মনে করছে, তদন্তের মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতেও চেয়েছিল খুনিরা।
এখনও পর্যন্ত কী কী অনুমান করতে পেরেছে পুলিশ?
ফরেন্সিক দল বাড়ির এক তলায় রক্তের দাগের মধ্যে এক মহিলার পায়ের ছাপ পেয়েছে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ও পারিপার্শ্বিক তথ্য থেকে আততায়ীদের সংখ্যা সম্পর্কেও ধারণা তৈরি হচ্ছে। কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন গোয়েন্দাকর্তা সমীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “নিহতদের দেহের আঘাতের চিহ্ন দেখে বোঝা সম্ভব, কত জন আততায়ী এসেছিল।”
ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিহতদের গলার নলি কাটার ধরন একই রকম। এ থেকে তদন্তকারীদের ধারণা, একাধিক আততায়ী থাকলেও মূল খুনি সম্ভবত এক জনই। সে-ই সম্ভবত চার জনের গলার নলি কেটেছিল। নলি কাটার ধরন দেখে তদন্তকারীদের অনুমান, ওই ব্যক্তি ডানহাতি।
খুনের কারণ নিয়ে কিন্তু শুক্রবারও ধোঁয়াশা কাটেনি। গৌরীদেবীর মেয়ে কেকা বছর খানেক আগে মারা গিয়েছেন। কেকাদেবীর স্বামী বুদ্ধদেব মুখোপাধ্যায়কে এ দিন জেরা করেছেন গোয়েন্দারা। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে শঙ্কর সিংহ নামে এক যুবককে। তিনি গৌরীদেবীর অন্য আয়া, সন্ধ্যা গোস্বামীর পরিচিত। প্রায়ই সন্ধ্যাকে তিনি এই এলাকায় পৌঁছে দিতেন। শঙ্করকেও সন্দেহের তালিকায় রেখেছে পুলিশ। ঘটনার দিন বিকেলে কাজে আসার কথা ছিল সন্ধ্যার। তিনি অসুস্থ থাকায় আসতে পারেননি। তাই সকালের ‘ডিউটি’তে থাকা ময়নাদেবীকে রয়ে যেতে হয়।
পুলিশের একাংশ মনে করছে, এই খুনের পিছনে পারিবারিক বা ব্যবসায়িক শত্রুতা থাকতে পারে। পুলিশ জেনেছে, দীপকবাবু ২০০৪ সালে বেহালা থানার বৈদ্যপাড়ার পৈতৃক বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে প্যারিসপাড়ায় চলে এসেছিলেন। পিতৃসূত্রে যৌথ সম্পত্তির একটি অংশের দাবিদার ছিলেন তিনি। দীপকবাবু দুই খুড়তুতো ভাই অলোক ও অশোকের অবশ্য দাবি, “আমাদের সঙ্গে প্রায় কুড়ি বছর দীপকের কোনও সর্ম্পক ছিল না। যৌথ সম্পত্তি নিয়ে দীপকরা কখনও কোনও দাবি করেনি।” পুলিশ আরও জানতে পেরেছে, বৈদ্যপাড়ারই কালীপদ মুখার্জি লেনে দীপকবাবুর যে সাড়ে তিন কাঠা জমি রয়েছে, অশোকবাবু তা কিনতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত দরদামে রফা হয়নি। জমি নিয়ে পারিবারিক বিবাদ ছিল কি না, খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
দীপকবাবু কেব্ল টিভির ব্যবসা ছিল। তাই ব্যবসায়িক দিক থেকে কোনও শত্রুতার সম্ভাবনা রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তাঁর অফিস এবং বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের দোকানের কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে গৌরীদেবীর ফিজিওথেরাপিস্টকেও। তিনিই প্রথম দেহগুলি দেখে পড়শিদের জানিয়েছিলেন। অণিমার পরিজনদের সঙ্গেও কথা বলছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশ জেনেছে, বৃহস্পতিবার জনকল্যাণ এলাকায় নিজের কেব্ল টিভির অফিসে যাননি দীপকবাবু। সারা দিন বাড়িতেই ছিলেন। বিকেলে এক বার পাড়ার চায়ের দোকানে যান। দীপকবাবু সন্ধ্যায় কয়েক জন ছাত্রকে পড়াতেন। পুলিশ সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার বিকেল এবং সন্ধ্যায় এক জন ছাত্র এসেছিল। যদিও কলিং বেল বাজিয়ে সাড়া না পেয়ে সে ফিরে যায়। সন্ধ্যা ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টা, ওই এলাকায় আচমকা লোডশেডিং হয়েছিল। তখনই খুনের ঘটনা ঘটেছিল কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
ফরেন্সিক দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পরে রাজ্য ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির অধিকর্তা জিতেন্দ্রনাথ পাল বলেন, “বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ হয়েছে। সেগুলি পরীক্ষা করলে আরও কিছু সূত্র মিলতে পারে।” পুলিশ যে সব নমুনা বাজেয়াপ্ত করেছিল, সেগুলিও ফরেন্সিক চেয়ে পাঠিয়েছে।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.