প্রবন্ধ ২...
যত খুশি জল তুলব?
ওঁরা ঠিক বলছেন না
খামখেয়ালি এই বর্ষার সময় কেমন চলছে আমাদের খারিফ চাষ, কী ভাবে কৃষকরা সামাল দিচ্ছেন সেচের জলের সংকট, তা দেখতে কয়েক দিন আগে মালদহ ও দুই দিনাজপুর জেলায় গিয়েছিলাম। ৩০ অগস্ট কলকাতায় ফিরে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন চোখে পড়ল। ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট-এর গবেষক অদিতি মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের ভূগর্ভের জল ও কৃষির সংকট নিয়ে নানা কথা। তাঁর মূল প্রতিপাদ্য, রাজ্যের ৩৮টি ব্লক বাদে বাকি এলাকায় ভূগর্ভের জলস্তর নেমে যাওয়ার খবর ভিত্তিহীন এবং সেচ-পাম্পের জন্য সুলভে বিদ্যুৎ দিতে পারলেই আরও বেশি জমিতে বোরো ধানের চাষ করে খাদ্য সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা যাবে।
মনে পড়ল মালদহের ষাটোর্ধ্ব কৃষক মন্টু ঘোষের কথা। মাত্র দুদিন আগে ভাদ্রের চড়া রোদে তাঁর জমিতে দাঁড়িয়ে মন্টু বলছিলেন, গত দুই দশকে মাটির নীচের জলস্তর অন্তত ১৫ ফুট নেমে গিয়েছে। আগে এক পাইপে অর্থাৎ ২০ ফুট গভীরে জল পাওয়া যেত, এখন মাটিতে একমানুষ সমান গর্ত করে পাম্প নামিয়ে দিলেও জল ওঠে না। তিনি আরও জানালেন, এ বার অনাবৃষ্টিতে আমন ধানের চাষ মার খেল, বোরো চাষের সময় জলাভাব আরও তীব্র হবে। কারণ বর্ষায় মাটির নীচের জলস্তর অপূর্ণ থেকে গেল। প্রায় একই অভিজ্ঞতা নদিয়ার তেহট্টের সফিকুল ইসলাম, হুগলির খানাকুলের রতন ঘোষ এবং বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের ভুতো মান্ডি ও বাপ্পা মালিকের। অহেতুক তালিকা দীর্ঘ করছি না।

পশ্চিমবঙ্গ জল অনুসন্ধান দফতরের একটি অপ্রকাশিত তথ্যভাণ্ডার দেখছিলাম। এই রিপোর্টের তথ্যই অদিতি ব্যবহার করেছেন। সংশ্লিষ্ট দফতরটি প্রায় ২০০০ কূপে জানুয়ারি ও এপ্রিল মাসে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের ওঠানামা পর্যবেক্ষণ করে রাজ্যের ৩৪১টি ব্লকের মধ্যে ৩৩৩টিতে গত তিন দশকে জানুয়ারি ও এপ্রিল মাসে জলস্তরের গভীরতার তথ্য-সারণি ওই রিপোর্টে দিয়েছে। কিন্তু ওই তালিকায় ৩৭টি ব্লকের তথ্য এত অসম্পূর্ণ যে তা নিয়ে কোনও বিশ্লেষণ চলে না। কিন্তু, সেই অসম্পূর্ণতাই এই বিশ্লেষণের মূল সমস্যা নয়।
কেন্দ্রীয় ভূজল বোর্ড জলস্তরের অবস্থা বিচার করার সময় মোট প্রাপ্য জলের কত শতাংশ ব্যবহৃত হয় তাও হিসেব করে। কিন্তু সেই হিসেব যথার্থ নয়। কারণ, প্রকৃতপক্ষে কত জল প্রতি বছর মাটির নীচে থেকে টেনে তোলা হয়, তা কেউ জানেন না । পশ্চিমবঙ্গ জল অনুসন্ধান দফতরের পূর্বোক্ত তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, ২০০২ থেকে ২০১১-র মধ্যে রাজ্যের ২৫৯টি ব্লকের জলস্তর নেমে গিয়েছে আর ৩৭টিতে জলস্তর উঠেছে। এর মধ্যে ১৫৭টিতে প্রতি বছর ২০ সেন্টিমিটারের বেশি হারে নেমে যাচ্ছে; সামগ্রিক গড় করলে দেখা যাচ্ছে রাজ্যের ২৯৬টি ব্লকে গত এক দশকে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের জলস্তর ২০.৩ সেন্টিমিটার আর এপ্রিল মাসের জলস্তর ২৫.৫ সেন্টিমিটার হারে নেমে গিয়েছে। অর্থাৎ পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
ক্ষুদ্র সেচ সমীক্ষার সূত্র থেকে অদিতি জানিয়েছেন, ২০০১ থেকে ২০০৬-এর মধ্যে রাজ্যের এক লক্ষাধিক সেচ-পাম্প অকেজো হয়ে গিয়েছে। এর কারণ কিন্তু ডিজেল বা বিদ্যুতের অভাব নয়। সেন্ট্রিফিউগাল নলকূপ বড়জোর আট মিটার গভীরতা থেকে জল টেনে তুলতে পারে, কিন্তু গত তিন দশকে জলস্তর এতটাই নেমে গিয়েছে যে ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ওই ধরনের পাম্প দিয়ে জল তোলা যায় না। এসেছে সাবমার্সিবল পাম্প, যা আরও গভীর স্তর থেকে জল তুলতে পারে।
অগভীর নলকূপের সংখ্যা কমলেও সেচসেবিত এলাকা কমেনি, বরং কিছুটা বেড়েছে। আগে একটি পাম্প দিয়ে চার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া যেত। এখন একটি সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে ছয় হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া যায়। সর্বশেষ সমীক্ষা অনুসারে, রাজ্যে ৫,১৯,৪৩৯টি গভীর ও অগভীর নলকূপ চালু আছে এবং সেচসেবিত এলাকার ব্যাপ্তি ১৬.৩৭ লক্ষ হেক্টর। কিন্তু অননুমোদিত পাম্পের সংখ্যা কত, কেউ জানেন না।
রাজ্যে প্রায় ১৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়, জল লাগে প্রায় ২১ ঘন কিলোমিটার, যা মূলত ভূগর্ভের জল। এই জলের চাহিদা ও ব্যবহার কোথাও কম, কোথাও বেশি। সেচের জন্য আরও বেশি জল তুললে গৃহস্থালীর চাহিদা মিটবে কোথা থেকে?

২০০৯-এ পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের হয়ে একটি গবেষণার সময় দেখেছি, আটটি জেলায় শুখা মরসুমে সেচের জলের চাহিদা জোগানের তুলনায় অনেক বেশি। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলেই আজ রাজ্যের ৮১টি ব্লকের মাটির নীচের জল আর্সেনিকে এবং ৪৯টির জল ফ্লোরাইডে বিষাক্ত। বেসরকারি মতে এই দূষণের ব্যাপ্তি আরও বেশি।
আর্সেনিকের বিষ পাওয়া যাচ্ছে ধান ও সব্জির মধ্যে। চুঁচুড়া ধান গবেষণা কেন্দ্রের কৃষিবিজ্ঞানীরা রাজ্যের চারটি এলাকায় ২০০ ধরনের ধানের উপর সমীক্ষা চালিয়ে প্রতি কিলোগ্রাম ধানে ৩৮ থেকে ২৭০০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক পেয়েছেন। ভূগর্ভের জল ক্রমাগত সেচের কাজে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে মাটির উপরের স্তরেও আর্সেনিক জমছে। পানীয় জলকে আর্সেনিকমুক্ত করার প্রকৌশল আমাদের জানা আছে, কিন্তু মাটির উপরের স্তরে আর্সেনিক জমলে তার কোনও চটজলদি সমাধান নেই।
তবু অদিতি বলেছেন, ভূগর্ভ থেকে আরও জল তুলে বোরো ধান চাষ করে খাদ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। প্রসঙ্গত তিনি গুজরাত, মহারাষ্ট্র ও পঞ্জাবের কথা বলেছেন। কিন্তু প্রথম সবুজ বিপ্লবের প্রভাবে পঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের মাটির নীচের জল যে তলানিতে ঠেকেছে, সে কথা বহু আলোচিত। ২০০৯-এর অগস্ট মাসে ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে নাসার তিন বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, ২০০২ থেকে ২০০৮-এর মধ্যে রাজস্থান, পঞ্জাব, হরিয়ানা ও দিল্লিতে ভূগর্ভ থেকে ১০৯ ঘন কিলোমিটার জল তোলা হয়েছে। এই ব্যবস্থা চলতে থাকলে প্রায় ১১.৪ কোটি মানুষ অচিরেই তীব্র জলসংকটের মুখোমুখি হবেন।
এই রাজ্যে যত বৃষ্টি হয় তার ২১ শতাংশ মাটির নীচের জলভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে। বর্ষার প্রথম পর্বে অনাবৃষ্টি আর শেষ পর্বে অতিবৃষ্টি কৃষিকে বিপর্যস্ত করে; নিরুপায় কৃষক ভূগর্ভের জলের উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। অদিতি লিখেছেন, তাঁর পরামর্শে রাজ্য সরকার ২০১১-র নভেম্বরে নির্দেশিকায় বলেছে, এখন থেকে পাঁচ অশ্বশক্তির সেচ-পাম্প বসাতে সংশ্লিষ্ট দফতরের অনুমোদন লাগবে না। তা-ই হলে ভূগর্ভস্থ জলের অবস্থা আরও খারাপ হবে।
শেষে বলি, বিষয়টি যখন সেচের জল, তখন গবেষণা শুরু হতে পারে কৃষকদের অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়ে। তাঁরাই দিতে পারেন সত্যের সুলুকসন্ধান।

ঋণ: দেবাশিস সেনগুপ্ত, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.