শিক্ষক বলতেন, ছাত্রছাত্রী শুনতেন। এখন পড়ুয়াদের কথাও
আমরা শুনছি।
সেটা খুব ভাল। লিখছেন বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক
বিশ্বজিৎ রায় |
মাস্টারি করে খাই। এ দেশে ক্লাসরুমের যা চেহারা, তাতে যিনি পড়াচ্ছেন তিনি এক দিকে একা, আর তাঁর সামনে ছাত্রছাত্রীর দল। শাসন ও ত্রাসনের অধিকার মাস্টারের, তাই একা হলেও তিনি ক্ষমতাহীন নন। তার ওপরে এ দেশে মাস্টারদের গুরুমশাই বলা হত। সে ডাকের ভার নিতান্ত কম নয়। গুরু মানে উত্তম, শ্রেষ্ঠ, প্রধান, মহান। বাপ রে বাপ! কী চাপ কী চাপ।
এটাই চলছে, চলবে? প্ল্যাটফর্মের এ দিকে যিনি, একা তিনিই শেখাবেন? উল্টো দিকে যারা আছে তাদের কাছেও তো শেখার অনেক কিছু রয়েছে। ইদানীং খেয়াল করে দেখেছি, চেষ্টা করলে এই গুরু গুরু রবের বাইরে আসা যাচ্ছে। আর সেটা সম্ভব হচ্ছে ওই সামনে বসে থাকা পড়ুয়াদের জন্যই। বিদ্যালয় শিক্ষার কথা বলতে পারব না, যে স্তরে শিক্ষকতা করতে হয় সেই স্তরের অধিকাংশ পড়ুয়া বিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে। তারা এখন দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ। তাদের মেজাজ, মর্জি না জানলে এই দেশের এখনকার চেহারার অনেকটাই অধরা থেকে যাবে। অনেকেই মনে করেন কুড়ি থেকে ত্রিশের মধ্যবর্তীরা পড়াশোনা করে না, এদের বড় অংশ উচ্ছন্নে গেছে। আমার কিন্তু তা মনে হয় না, বরং এরা অনেক খোলামেলা, সপ্রতিভ, প্রত্যয়ী, কোদালকে কোদাল বলতে কসুর করে না, নীতিবায়ুগ্রস্ততা ও মূল্যবোধের দেখানেপনা নেই। পড়াশোনার ব্যাপারেও নিজেদের স্পষ্ট মতামত আছে।
শরৎ রোদে যাদবপুরের ক্যাম্পাসে দেবায়ুধের সঙ্গে দেখা। ইংরেজি পড়ে, বাংলায় কবিতা লেখে। আজকাল ইংরেজির অনেক পড়ুয়াই বেশ বাংলাচর্চা করছে। ভাল লাগে। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণও বটে যে দ্বিভাষিকতার সামর্থ্যে ভদ্রলোক বাঙালিরা একদা বেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন, মাঝখানে প্রাথমিকে ইংরাজি হঠাও শিক্ষানীতির দাপটে ও বাংলা মাধ্যম স্কুলের এক রকম অন্তর্জলি যাত্রায় সেই দ্বিভাষিকতা বেশ মার খেয়েছিল। ইদানীং আবার সেই জোরটা অনেক ছেলেমেয়ের মধ্যেই ফিরে আসছে।
তো, যে কথা বলছিলাম। পথচলতি দেবায়ুধ তার এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে। ওই ছেলেটি কী করে, সে কথা জানাল আমাকে। আবার আমি কী করি, সেটাও বন্ধুকে বলল, খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই। শুনে ভবলাম, যখন ছাত্র ছিলাম, কোনও শিক্ষককে কি সামনাসামনি কোনও সহপাঠীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতাম? ভাবতে পারতাম পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা? মাস্টারমশাইদের সম্বন্ধে একটা সম্ভ্রমাত্মক দূরত্ব বোধ করতাম আমরা। অথচ এই পরিচয় করিয়ে দেওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তাই এই সপ্রতিভ স্বাভাবিকতাটুকু বেশ লাগল। পড়াটাও বৃত্তি, পড়ানোটাও। দু’দলই তো আসলে এক নৌকার যাত্রী। এই বোধটা থাকলে অনেক কিছু শেয়ার করতে সুবিধে হয়। |
ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষা। ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির একটি দৃশ্য। |
অর্ণব দত্ত। পড়ে তুলনামূলক সাহিত্য। সাহিত্য পড়াটা তার প্যাশন। পড়াশোনার প্রতি এক ধরনের রোমান্টিক আবেগ না থাকলে কি আর পড়াশোনা হয়! সাহিত্যপড়ুয়াদের মধ্য থেকে এই প্রেমপ্রীতিটা উঠে যাচ্ছে বলে অনেকেই হা-হুতাশ করেন অর্ণবকে দেখলে কিন্তু মত বদলাতে হবে। একটা লেখা নিয়ে মতবিনিময় হচ্ছিল ফেসবুকে। সাহিত্য বিষয়ক লেখা। কিন্তু লেখাটা অর্ণবের ভাল লাগেনি। মনে হয়েছে সমাজবিজ্ঞানীর বুকনিতে ভরা। কথাটা ভাববার। সত্যিই তো, সাহিত্য পাঠের ও চর্চার যে স্বাতন্ত্র্য থাকার কথা তা ভুলে গিয়ে সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসবিদ্যার দিকে মুখ তুলে তাকানোই অনেক সাহিত্যবিদ্যাচর্চাকারীর দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্য বিদ্যাবিষয়ের সঙ্গে সহযোগ আর বিনিময় সম্পর্ক থাকাটা সুস্বাস্থ্যের চিহ্ন ঠিকই, কিন্তু তা বলে অন্য বিষয়ের অধীন হওয়া তো ভাল নয়। মনে পড়ল, বছর কয়েক আগে শিমলায় এক জমায়েতে শেলডন পোলক আক্ষেপ করছিলেন টেক্সট না-পড়া নিয়ে। সাহিত্য পড়া ও পড়ানোর চলতি সিস্টেমে টেক্সট পড়াটা অনেক সময় গৌণ হয়ে যায়। প্রবীণ ইতিহাসবিদ মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, ধরে ধরে কালিদাসের কোনও কাব্য বা নাট্য পড়ার মজাই আলাদা। সাহিত্য পাঠকের এই আত্মমর্যাদাবোধ অর্ণবের অধিগত। এবং সে নিজের বোধদীপ্ত মতামত স্পষ্ট ভাষায় জানাতে দ্বিধা করে না।
শুধু কি পড়াশোনার মেজাজমর্জি জানার জন্যই এদের দিকে কান পাতব? এদের কথা শুনতে হবে জীবনবোধের জন্যও। জিয়া হক ভরপুর কবি। আগে থেকেই এক বন্ধু শিক্ষক সতর্ক করেছিলেন, ভাল না লাগলে জিয়া ক্লাস করে না। সে তো আমরাও সব ক্লাস করতাম না। কিন্তু করতাম না বলে কোথাও একটা লুকনো কুণ্ঠা ছিল। এদের সেটা নেই। না থেকে বেশ হয়েছে। ভাল লাগার ও ক্লাস করার দায়টা এক পক্ষের হবে কেন? ভাল লাগানোর দায়িত্বও তো অন্য পক্ষকে নিতে হবে। ফুটের দোকানে বসে চা খেতে খেতে জিয়া পদ্য সংক্রান্ত গদ্য নিয়ে কথা বলে চলে। জিগ্যেস করে, আপনাদের সময় কেমন ছিল যাদবপুর?
তার মানে অবশ্য এ নয় যে, উজ্জ্বল মুখগুলো কেবল কলকাতায়, যাদবপুরে, প্রেসিডেন্সিতেই। যেখানে আমাকে নিয়মিত পড়াতে হয় সেই বিশ্বভারতী কলকাতা থেকে দূরে। এখানে পড়াতে এসে ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে খুব বড় একটা জিনিস শিখেছি। প্রকৃতি সংলগ্ন উদারতায় বড় হয়ে ওঠে বলেই হয়তো এদের মন অনেক বেশি সংবেদনশীল। মনেরও যে গভীর বুদ্ধি আছে আর সাহিত্য পড়তে গেলে যে সেটা খুবই কাজে লাগে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেক সময় শহর থেকে দূরে থাকার ফলে সব কিছু জোটে না, কিন্তু মন তৈরি হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকে আশ্রমের এই পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা সংঘমিত্রা ঘোষ একটা গুরুভার তত্ত্ব-কণ্টকিত নিবন্ধ পড়ে বলল, লেখকের পণ্ডশ্রম। মাঝে মাঝেই আমাকে ভণ্ড বলে। সত্যিই তো, অনেক সময় পরিভাষা আর তত্ত্বের বুকনিতে মূল বিষয়টাকে গুলিয়ে ঢেকে দেওয়ার আর বাহবা কেনার প্রয়াস থাকে। যেটা বলতে চাওয়া হচ্ছে সেটা বলতে পারার সামর্থ্য নেই বলে নানা আবরণ ও আভরণ, তত্ত্ব ও পরিভাষা ফুটনোটে রেফারেন্স হয়ে থাকে মাত্র, তার এনগেজমেন্ট হয় না। জীবন সম্পর্কেও কথাটা সত্যি। কথা আর কাজ মেলে না। এ তো ভণ্ডামিই! ওর মনের বুদ্ধি সেটা টের পায়।
এই ছেলেমেয়ের দল যে কোনও শিক্ষকের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতার বাইরে থাকা ছটফটে মানুষগুলো শিক্ষা ক্ষেত্রে এক অর্থে সাবঅলটার্ন। ওদের আয়নায় শিক্ষকরা যদি মুখ দেখেন, তা হলে প্রতিষ্ঠানের জড়ত্ব থেকে মুক্তি মিলতে পারে।
শিক্ষক দিবসে কেবল শিক্ষকদের প্রতি পড়ুয়ারা প্রণত হবে কেন? শিক্ষকদেরও সামনের দিকে তাকিয়ে সেলাম জানাতে হবে। |