বিতর্ক...
পিৎজা-দোসা বাঙালি খাবার
পক্ষে
বাংলার চাউ, বাংলার চাঁপ
অফিসপাড়াকে কেন্দ্র করে রমরমিয়ে ব্যবসা করে চলেছে কিছু চাউমিন, পঞ্জাবি রুটি-তরকা কিংবা ইডলি-দোসার স্টল। টিফিন টাইমে বা অফিস ফেরতা প্রায় হাজার হাজার কর্মচারী ওই সমস্ত দোকানে ঢোকেন। এই বার ভেবে দেখুন, যে মানুষটি ওই দোকানে রুটি দিয়ে ছোলে-মশালা খাচ্ছেন, তিনি কি তখন মনে করেন যে রুটি দিয়ে ছোলে-মশালার বদলে লাল ছোলা আর নারকেল দিয়ে মোচার ঘণ্ট হলে ভাল হত? নাকি যে মানুষটি দোসা খাচ্ছেন, সে মনে করবেন, দোসাতে টক না হয়ে কাঁচালঙ্কার ঝাল হলে বাঙালিয়ানাকে বজায় রাখা যেত। আরে মশাই, রাতে শোবার আগে নিয়ম করে শরৎচন্দ্র পড়া এক সাধারণ বাঙালি সারাটা দিন একটি ঘিঞ্জি অফিস চত্বরে কাজ করার পর বাইরের ক্যান্টিনে যদি চটজলদি দুটো ইডলি বা একটি দোসা গলাধঃকরণ করেন, তা হলে তাঁর বাঙালি সত্তায় এমন কিছু আঘাত পড়ে না, বরং সেই পরিস্থিতিতে পাত পেড়ে ভাত-ডাল-আলুপোস্ত-মাছের ঝোল খাওয়াটা রীতিমতো হাস্যকর হয়ে ওঠে।


বাঙালির পায়ের নীচে সরষে। তাই বাঙালি কাশ্মীর, কন্যাকুমারীকা না হলে নিদেন পক্ষে দিঘা, পুরী, দার্জিলিং। বাঙালির পায়ের নীচে সরষের মতো জিভও লক-লক করে। ঝালে-ঝোলে-অম্বলে থাকা বাঙালি সবেতেই আছে। সাহেবদের কেক, মুসলমানের বিরিয়ানি-চাঁপ, ভিন রাজ্যের ইডলি-দোসা, পানিপুরি, চাট, পাপড়ি তো কবেই আম বাঙালির ঘরে ঢুকে পড়েছে। বাঙালি শুকতো, মোচার ঘণ্ট, মুড়িঘণ্ট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ও সব এখন ইতিহাস। ভিন রাজ্যে গেলেই বুঝতে পারা যায়, হোটেলের সামনে বাঁকা-বাঁকা অক্ষরে লেখা ‘এখানে আলুপোস্ত পাওয়া যায়’। বাঙালি যেন আলুপোস্ত ছাড়া কিছুই খায় না। চিংড়ির মালাইকারি, ভাপা ইলিশ, এগুলো যেন নাগালের বাইরে। এখানে সাহেবরা ভাগ বসিয়েছে। বাঙালি সব সময়ই বিকল্প খোঁজে। সস্তার খাবার দোসা অনেক দিন আগেই অফিসবাবুদের টিফিনে ঢুকে পড়েছে। পিৎজার ছোট সংস্করণ এখন কেক, পেস্ট্রির মতো বাঙালির খাবার। শক-হুন-পাঠান-মোগল কবেই এ দেশের মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছে! তাদের খাবারের সঙ্গে আমাদের সখ্যতা হলে দোষ কোথায়?
প্রাদেশিকতার গণ্ডি ভেঙে রন্ধনপটু ভোজনে বিচিত্রবিলাসী বাঙালি পিৎজা-দোসাকে আপন করে সমৃদ্ধ করেছে নিজের জলখাবারের তালিকাকে। বাঙালির নিজস্ব ঘরানার খাবারগুলি থেকে পিৎজা-দোসা সম্পূর্ণ ভিন্নতর স্বাদের। বাঙালির রসনা সহজেই আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। ঘরের বাইরে পথে-ঘাটে হোটেল-রেস্তোরাঁয় সহজে মেলে। খাদ্যগুণ যথেষ্ট আর স্বাস্থ্যসম্মতও বটে, সর্বোপরি মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে। আজকাল রেডি-টু-কুক মেটিরিয়ালের গুণে অনায়াসে বাঙালি হেঁশেলে জায়গা করে নিয়েছে পিৎজা-দোসা। গৃহিণীদের আর নিত্য নতুন জলখাবারের ভাবনা নিয়ে মাথ্যব্যথা নেই। জয় হোক বাঙালির পিৎজা-দোসার।
চিকেন টিক্কা বাটার মসালা যদি ব্রিটেনের ‘ন্যাশনাল ডিশ’ হতে পারে, তবে পিৎজা-দোসার বাঙালিত্বে আপত্তি কী?

বিপক্ষে
আজও খুঁজি ‘বউদির হোটেল’
পিৎজা-দোসা যদি সর্বতোভাবেই ‘বাঙালি খাবার’ হয়ে উঠতে পারত, তা হলে পশ্চিমবঙ্গ বাদে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে এমনকী বিদেশেও গড়ে উঠত না ‘আদর্শ বাঙালি হোটেল’ বা ‘দাদা-বউদির হোটেল’ কিংবা বাঙালি কাফে বা রেস্তোরাঁ, সেখানে উপচে পড়ত না বাঙালির ভিড়! হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে, ‘অনুকরণপ্রিয়’ ‘ভোজনরসিক’ বাঙালি কোনও বর্ষণস্নাত সকালে বা আলোকোজ্জ্বল সন্ধ্যায় অতিথির খাদ্য-তালিকায় স্বাদবদল ঘটাতে আশ্রয় নেন পিৎজা বা চাউমিনের, অসুস্থ ভেলোরগামী বাঙালি দোসা-ইডলি’তে উদরপূর্তি করেন। কিন্তু ‘কর্পোরেট’ বাঙালিরও সারা দিনের খাদ্য-তালিকায় অন্তত এক বার হলেও কাঙ্ক্ষিত ‘ভাত-মাছের ঝোল’ আজও! আজও সুযোগ পেলেই পিঠে-পার্বণে বাঙালি কচিকাঁচারা লালায়িত হয় পাটিসাপ্টা-পুরপিঠে কিংবা তাল-ফুলুরি চেখে দেখতে।
তাই প্রয়োজনে বা স্বাদবদলে পিৎজা-দোসার কাছে বাঙালি নতজানু হলেও, এ জাতীয় খাবার খাঁটি ‘বাঙালিয়ানা’র সঙ্গে আজও সম্পৃক্ত হতে পারেনি।
উৎস বা উৎপত্তিস্থল (দেশ বা অঞ্চল)-এর নামানুসারে কোনও কোনও খাবারের নামকরণ হয়ে থাকে। যেমন ইতালীয় খাবার, চাইনিজ খাবার, বাঙালি খাবার, ইত্যাদি। এসব খাবার স্ব-স্ব দেশ বা অঞ্চলের একান্ত ভাবেই নিজস্ব খাবার। পিৎজা, দোসা বা চাইনিজ কোনও কোনও বাঙালি শখ করেই ওসব খাবার খেয়ে থাকেন। তাই বলে ওগুলো ‘বাঙালির খাবার’ রূপে গণ্য হতে পারে না, এমনকী বাঙালিরা ওগুলিকে নিজেদের খাবার বলে দাবি করতেও পারে না। যেমন, জার্মানরা নিজেদের খাবার রূপে দাবি করতে পারেন না বাংলার পিঠে-পুলি-রসগোল্লা-সন্দেশকে বা মোগলদের সৃষ্টি বিরিয়ানিকে। তাই পিৎজা-দোসা বাঙালি খাবার নয়।
বাঙাল-ঘটির ঝগড়া মিটিয়ে নিলে ছাপ্পান্ন নয়, ছাপ্পান্নশো রকমের পদ রয়েছে বাঙালির ঝুলিতে। বাঙালির ডেসার্ট পিঠে-পায়েস থেকে শুরু করে চিতল মাছের মুইঠ্যা-ই হোক বা চিংড়ির মালাইকারি, রসগ্রাহী বাঙালির খাদ্য-তালিকার বহর কিছু কম নয়। উদারমনা বাঙালি খেতেই পারে পিৎজা-দোসা-চাইনিজ-কন্টিনেন্টাল, কিন্তু তা বলে সেগুলিকে ‘বাঙালি’ তকমা দেওয়া চলে না।
গ্রাম্য পরিবেশের মধ্যে বড় হওয়ার সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, গ্রামের অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা পিৎজা, দোসার বাস্তব রূপটির সঙ্গে পরিচিত নন। আবার, শহরের সচ্ছল মানুষের প্রাত্যহিক মেনু-তালিকার মধ্যেও এগুলো পড়ে না। সেখানে আরও অনেক মুখরোচক যুক্ত হয়। কিন্তু এই দুই ভিন্ন পরিবেশের বাঙালিদের প্রাত্যহিক (বেশির ভাগ দিনই) মেনু-তালিকায় কমন খাদ্য ভাত-মাছ। সর্বোপরি ‘বাঙালি’ ও বাঙালি খাবার ভাত-মাছের দ্বারাই বাঙালি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশে কিছুটা হলেও বাঙালিয়ানার পরিচয় বহন করে কিন্তু পিৎজা-দোসায় নয়। তা হলে এর থেকে কি আমরা বলতে পারি ‘পিৎজা-দোসা’ বাঙালি খাবার? কখনওই না।

অক্টোবর মাসের বিতর্ক
আপনার চিঠি পক্ষে না বিপক্ষে, তা স্পষ্ট উল্লেখ করুন।
চিঠি পাঠান ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই ঠিকানায়
অক্টোবর মাসের বিতর্ক,
সম্পাদকীয় বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.