মেয়েদের অপুষ্টি নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর মন্তব্যে সমালোচনার ঝড় উঠলেও তাঁর বক্তব্যের একটা অংশকে সমর্থনই করছেন এ রাজ্যের চিকিৎসকেরা। তাঁদের মতে, সুন্দর হওয়ার মরিয়া তাগিদে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে চূড়ান্ত অপুষ্টিতে ভোগা অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। কারও-কারও এই তাগিদ ‘অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার’ বা মানসিক রোগের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। অনেকে আবার ‘অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা’ বা ‘বুলিমিয়া’র মতো মানসিক-স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে চলে যাচ্ছেন।
অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা অর্থাৎ যে রোগে রোগী মোটা হওয়ার ভয়ে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেয়। আর বুলিমিয়া মানে, একটু বেশি খেয়ে ফেললেই রোগী ভাবে সে অপরাধ করে ফেলেছে, তাই বমি করে বা জোলাপ জাতীয় ওষুধ খেয়ে খাবার শরীর থেকে বার করার চেষ্টা করে। সেই কবে ১৮৭৩ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক স্যর ইউলিয়াম গুল অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসার কয়েকটি কেস নিয়ে মেডিক্যাল পেপার প্রকাশ করেছিলেন। ওই একই বছর এই বিষয় নিয়ে গবেষণাপত্র বেরিয়েছিল ফরাসি ডাক্তার আর্নেস্ট শার্ল লালগু-র।
ফিল্মের তারকা, মডেল বা গ্ল্যামার জগতের সঙ্গে যুক্তদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। অভিনেত্রী অড্রে হেপবর্ন, গায়ক এলটন জনের মতো সেলিব্রিটি থেকে শুরু করে আমেরিকান গায়ক কারেন কার্পেন্টার, অভিনেত্রী সুশান পিটার্স, ফরাসি ফ্যাশন মডেল ইসাবেলা কারো, মডেল এলিয়ানা রামোশ অ্যানোরেক্সিয়া-আক্রান্ত বিখ্যাতদের তালিকা সুদীর্ঘ। এঁদের অনেকেই অবসাদে মৃত্যু বেছে নিয়েছিলেন। |
২০০৩ সালে নয়ডায় শুভ্রা তনওয়ার নামে ১৯ বছরের এক উঠতি মডেল আত্মহত্যা করেছিলেন। বাড়ির লোকই পরে জানান, ওজন বেড়ে যাওয়ার চরম মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন শুভ্রা। একই কারণে ঠিক তার পরের বছর মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিলেন দিল্লির রাজেন্দ্র নগরের বাসিন্দা বছর তিরিশের মডেল রাখী মিশ্র।
সমস্যাটা শুধু তারকাদের নয়। কলকাতায় বাইপাসের ধারে এক হাসপাতালে বছরখানেক আগে এক ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীকে ভর্তি করতে হয়েছিল। রোগা হওয়ার জন্য খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের কাছে এই মূহূর্তে বছর এগারোর একটি মেয়ের কাউন্সেলিং চলছে। যে রোগা হতে খাওয়ার পরেই গলায় আঙুল দিয়ে বমি করত। নীলাঞ্জনার কথায়, “ছোটবেলা থেকেই আমরা মেয়েদের হাতে স্লিম-ট্রিম বার্বি ডল ধরিয়ে দিচ্ছি, ছোট মেয়ের মনে ‘টুইগি ফিগার’-এর ছবি এঁকে দিচ্ছি। অনেক মেয়ের মাথায় ঢুকেছে, রোগা হলে সে সবার বাহবা পাবে, ভাল পাত্র পাবে। স্বচ্ছল থাকার পথ সুগম হবে।”
তবে পিছিয়ে থাকছে না ছেলেরাও। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এন্ডোক্রিনোলজির বিভাগীয় প্রধান নীলাঞ্জন সেনগুপ্ত-র কাছে কিছু দিন আগেই ২৫-২৬ বছরের একটি ছেলে এসেছিল। রোগা হয়ে গার্লফ্রেন্ডের প্রশংসা পেতে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায়। নীলাঞ্জনবাবুর কথায়, “চটজলদি ক্র্যাশ ডায়েটে যে কিছু হয় না, স্বাস্থ্যকর খাবার বার বার অল্প করে খেলেই ওজন ঠিক থাকে, এই সারসত্যটাই অনেকে বুঝছেন না। ফলে কার্ডিয়াক অ্যারিদমিয়া থেকে শুরু করে ভিটামিনের অভাবজনিত সমস্যা, পিরিয়ড অসময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া, মেটাবলিক সমস্যা, খিটখিটে হয়ে যাওয়া, দুর্বলতা, স্মৃতি কমে যাওয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।”
চিকিৎসক স্বাতী চক্রবর্তী আবার জানান, অনেক মহিলাই এক বার মোটা থেকে অনেক চেষ্টায় রোগা হওয়ার পর আবার মোটা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ভুগে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে ফেলেন। এতে তাঁদেরও অপুষ্টি বেড়ে যায়। পৃথিবী বিখ্যাত টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব অপরা উইনফ্রে-ও একই সমস্যার শিকার হয়েছিলেন। ডায়েটিশিয়ান রনিতা ঘোষের কথায় আবার, “ডায়েটিং মানেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মনে করে উপোশ করা। ডায়েটিং মানে শরীরের প্রয়োজন মতো সুষম, পরিমাণমতো খাবার খাওয়া।”
ঠিক এই কথাটাই বলছেন টলিউড অভিনেত্রী কোয়েল-শুভশ্রীরা। কোয়েল মল্লিক যেমন মনে করেন, “মোদীর কথাটা অনেকাংশেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে অনেকটা সত্যি। না-জেনে, ভুল প্রক্রিয়ায় রোগা হতে গিয়ে অনেকে অপুষ্টির শিকার হচ্ছেন।” শুভশ্রীর কথাতেও, “মোটা হওয়ার ভয়টা নায়িকাদের মনে সব সময় থাকে। তাই বলে আমরা কিন্তু না খেয়ে থাকি না। ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিয়ে খাই, ব্যায়াম করি। আসল কথাটা হল সুস্থ থাকা।”
ফিল্ম তারকাদের মানসিকতাও এখন বদলাচ্ছে। ক’দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে অভিনেত্রী বিদ্যা বালান জানিয়েছেন, কোনও ‘প্রোটোটাইপে’ তিনি আটকে থাকতে চান না। মোটা হওয়া নিয়ে তিনি বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। ‘ডার্টি পিকচার’ ছবিতে মোটা শরীরে অভিনয় করেই তিনি দর্শকের প্রশংসা পেয়েছেন। চিকিৎসকদের আশা, এই ভাবে হয়তো মাত্রাতিরিক্ত রোগা হওয়ার ‘অবসেশন’-থেকে বার হতে পারবে নতুন প্রজন্ম। |