বুদ্ধির দৌড়ে পিছিয়ে দেয় বাড়তি মেদের বোঝা
শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকলে মোটাসোটা কেউ বলতেই পারেন, আমি আমার মতোই ভাল। উড়িয়ে দিতে পারেন ছিপছিপে বন্ধুবান্ধবের কটাক্ষ কিংবা গ্ল্যামার দুনিয়ার হাতছানি। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, মেদবাহুল্য অনেক ক্ষেত্রে বুদ্ধির দৌড়েও পিছিয়ে দেয়!
কী রকম?
মোটা মানুষদের শরীরে কিছু বিশেষ সমস্যা প্রায়শই থাকে। যেমন, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা রক্তে বাড়তি কোলেস্টেরল। চিকিৎসকদের ভাষায় একে বলা হয়, ‘মেটাবলিক সিনড্রোম’। সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, মেটাবলিক সিনড্রোম থাকলে তা বুদ্ধি বিকাশের ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ফ্রান্সের গবেষণাগার ইনসার্ম-এর বিজ্ঞানীরা এক দশক ধরে ব্রিটেনের সাড়ে ছ’হাজার সরকারি কর্মীর উপরে সমীক্ষা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন। বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নিউরোলজি’-তে প্রকাশিত হয়েছে এই সমীক্ষার রিপোর্ট।
ইনসার্ম-এর বিজ্ঞানীরা তাই বলছেন, সুস্থ-তরতাজা মন পেতেও বাড়তি মেদ ঝরানো দরকার। কারণ স্থূলকায়দের মধ্যে যাঁদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা কোলেস্টেরলের মতো ‘মেটাবলিক সিনড্রোম’ রয়েছে, তাঁরা কিছু মানসিক ক্ষমতার (হায়ার কগনিটিভ ফাংশান) ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ওজনের মানুষের থেকে পিছিয়ে। ‘হায়ার কগনিটিভ ফাংশান’ বলতে মূলত বুদ্ধির উচ্চ স্তরের তিনটি দিকের কথা বোঝানো হয়।
এক, কোনও বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা (থিংকিং)। দুই, যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা (রিজনিং)। এবং তিন, স্মৃতি বা মনে রাখার ক্ষমতা (মেমোরি)। সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, ‘মেটাবলিক সিনড্রোম’ (খাদ্যগ্রহণ থেকে পুষ্টি পর্যন্ত শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় বিশেষ কিছু সমস্যা) আছে এমন মোটা মানুষদের মধ্যে ওই তিন মানসিক ক্ষমতার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। যা থেকে গবেষকদের ধারণা, স্থূলত্বের (ওবেসিটি) সঙ্গে যোগ থাকতে পারে স্মৃতি-বিভ্রম বা ভুলে যাওয়া (ডিমেনসিয়া)-র মতো মানসিক উপসর্গেরও।
স্মৃতির ভাঁড়ার তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এমন কোনও অভিজ্ঞতার কথা অবশ্য ‘মনে’ করতে পারলেন না গায়ক প্রতীক চৌধুরী। বাড়তি ওজন নিয়ে অস্বস্তিহীন প্রতীক বললেন, “বাকিদের মতোই মাঝেমধ্যে টুকিটাকি জিনিস ভুলে যাই। কিন্তু তা কখনওই ডিমেনসিয়ার মতো মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে যায়নি।” তবে গান গাওয়ার সময় সেই ছোটবেলা থেকেই নিজের গানের খাতাটি সামনে খোলা রাখেন তিনি। ভয়, পাছে শব্দ ভুলে যান! হেসে উঠলেন প্রতীক।
প্রতীক হাসলেও বিষয়টি নিয়ে কিন্তু কপালে ভাঁজ পড়েছে বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের দাবি, বিশ্বে প্রতি চার সেকেন্ডে এক জন ডিমেনসিয়ায় আক্রান্ত হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র হিসেব মতো ২০৩০ সালের মধ্যে এই উপসর্গ দেখা দিতে পারে প্রায় সাড়ে ছ’কোটি মানুষের মধ্যে। মূলত ডিমেনসিয়ার এমন বাড়বাড়ন্ত দেখেই তার সম্ভাব্য কারণ খোঁজার কথা পরিকল্পনা করেছিলেন ফ্রান্সের ওই গবেষক দল।
এ কাজের জন্য তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন ব্রিটেনের মাঝবয়সী সাড়ে ছ’হাজার সরকারি কর্মীকে। প্রথমে ওজনের ভিত্তিতে তাঁদের দু’টি ভাগে ভাগ করেন। দেখা যায়, স্থূলদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশেরই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা কোলেস্টেরলের সমস্যা রয়েছে। এ বার সব কর্মীরই মানসিক ক্ষমতার পরীক্ষা নেওয়া হয় দশ বছরে মোট তিন বার। মূলত মাপা হয় তাঁদের চিন্তাশক্তি, যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি। এ বার নম্বরের ফারাক থেকেই উঠে আসে একটা স্পষ্ট ছবি। দেখা যায়, স্থূলদের মধ্যে যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা কোলেস্টেরলের সমস্যা রয়েছে তাঁরা সব ধরনের পরীক্ষাতেই স্বাভাবিক ওজনের মানুষদের থেকে অন্তত ২৫ শতাংশ কম নম্বর পেয়েছেন। বিশেষ করে স্মৃতিশক্তির ফারাক থেকেই গবেষকদের ধারণা হয়েছে, মোটাদের ‘ডিমেনসিয়া’-তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
যদিও স্থূলতার সঙ্গে এর সম্পর্ক নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত বিশেষজ্ঞদের একাংশ। একটি মহলের মতে, কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আগে এ সম্পর্কে আরও গবেষণা দরকার। এর পিছনে কোনও জিনগত কারণ রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখার কথা বলছেন তাঁরা। তবে অন্য মহলের মতে, ডিমেনসিয়ার সঙ্গে স্থূলতার সম্পর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই ধরনের মানসিক সমস্যাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সুজয় ঘোষ ওই গবেষণার প্রসঙ্গে বললেন, “উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, বা ডায়াবেটিস এই সব কিছুই রক্ত সংবহনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই রোগগুলির ফলে যেখানে রক্ত সংবহনে অসুবিধা হয়, সেখানে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। মস্তিষ্কে হলে মস্তিষ্ক-নিয়ন্ত্রিত কাজগুলি ব্যাহত হতেই পারে। যার প্রভাবে ডিমেনসিয়ার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।” যদিও রোগীদের কাছে সাধারণ ভাবে প্রাধান্য পায় শারীরিক সমস্যাই। ফলে তাঁরা অনেক সময়ই আনুষঙ্গিক সমস্যার কথা চিকিৎসককে বলেন না। তাই পুরো ছবিটা বোঝা যায় না বলে জানালেন সুজয়বাবু।
একই কথা বলছেন মনোবিদদের একাংশও। তবে তাঁদের ব্যাখ্যাটা একটু অন্য রকম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপিকা নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, “প্রথমত, মোটা মানুষদের অধিকাংশই খেতে ভালবাসেন। তাঁরা আরাম, সুখ, তৃপ্তি ইত্যাদিকে বেশি গুরুত্ব দেন। যাতে অবহেলিত হয় চিন্তা-যুক্তি-স্মৃতি (থিংকিং-রিজনিং-মেমোরি)-র মতো ‘হায়ার কগনিটিভ ফাংশান’।” মূলত চর্চার অভাবেই এই ক্ষমতাগুলোর বিকাশে বাধা পড়ে। “দ্বিতীয়ত, ডায়াবেটিসের মতো রোগ থাকলে এমনিতেই শরীরে এক ধরনের ক্লান্তি বাসা বাঁধে। যা কমিয়ে দিতে পারে বিভিন্ন ধরনের মানসিক ক্ষমতাও।”
এই পরিস্থিতিতে মেদ ও মনের ‘অবিচ্ছেদ্য’ সম্পর্ক খুঁজে পেয়েই ওজন কমাতে ফরাসি বিজ্ঞানীদের পরামর্শ পুষ্টিকর খাবার খান, পরিমিত খান, ধূমপান ছেড়ে ব্যায়াম করুন নিয়মিত। বাড়তি মেদের চাপে যাতে কোনও ভাবেই চাপে না পড়ে শরীর বা মন, সে দিকে খেয়াল রাখতেই চাপ দিচ্ছেন তাঁরা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.