দু’টোই মশাবাহিত রোগ। বছর বছর হানা দেয়। তবে মানবশরীরে দু’টোর প্রতিক্রিয়া এত দিন ছিল দু’রকম।
কিন্তু এ বার দুই রোগের শারীরিক প্রতিক্রিয়া অনেকটা মিলে যাওয়ায় চিকিৎসক-গবেষকেরা বিস্মিত, বিভ্রান্তও। রোগ ধরতে ডাক্তারদের বিলক্ষণ সমস্যা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, মানবদেহে দুই জীবাণুর প্রতিক্রিয়ার ধরন কি পাল্টে গেল?
রোগ দু’টো ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি। ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার জীবাণু পরজীবী প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম। সেটা বহন করে অ্যানোফিলিস ইনসিপিডাস মশা। ডেঙ্গির জীবাণু ভাইরাস। বাহক মশা এডিস ইজিপ্টাই। এমনিতে শরীরের ভিতরে পরজীবী ও ভাইরাসের প্রতিক্রিয়ার ধরন আলাদা। যা দেখে বলা যায়, জীবাণুটা কী। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শরীরী প্রতিক্রিয়া দেখে রোগ বোঝা যাচ্ছে না। রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। কেন?
চিকিৎসকদের অনুমান, হয় এ বার ডেঙ্গি-ভাইরাস চরিত্র পাল্টে ফেলেছে, বা তার সংক্রমণে মানবকোষে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ধরন পাল্টেছে। কারও মতে, দু’টো রোগের জীবাণু ঢুকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। যা-ই হোক চিকিৎসকেরা বিভ্রান্ত। কারণ, সাধারণ ডেঙ্গিতেও বুকে-পেটে জল জমছে, পেটের মধ্যে অল্প রক্তক্ষরণও। অর্থাৎ হেমারেজিক ডেঙ্গির উপসর্গ! যা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতেও দেখা যায়। |
দক্ষিণ কলকাতায় পুরসভার একটি প্রাথমিক
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডেঙ্গির জন্য রক্ত পরীক্ষা। ছবি: রাজীব বসু |
এতেই বিপত্তি। পরজীবী-বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী দৈনিক গড়ে অন্তত ২৫ জন ডেঙ্গি-রোগী দেখছেন। তাঁর কথায়, “এত দিন প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরামের যে প্রতিক্রিয়া পাচ্ছিলাম, এ বার ডেঙ্গিতে তেমন মিলছে।” এখন ডেঙ্গি-ভাইরাস যে ভাবে খাদ্যনালী ও লিভারকে বিকল করছে, এত দিন তা ফ্যালসিপেরাম করত বলে তাঁর দাবি। বললেন, “৭০% রোগীর লিভারের নির্দিষ্ট কিছু উৎসেচক নির্গমন অন্তত ১৫ গুণ বাড়ছে। তাতে হেপাটাইটিস, কোলাইটিস হচ্ছে। ভুগতে হচ্ছে কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়েরিয়ায়।”
অমিতাভবাবু জানালেন, প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরামের সংক্রমণে এ ভাবেই লিভারের উৎসেচক আচমকা অনেকটা বেড়ে যায়। পেটে জল জমে। কখনও খাদ্যনালীতে রক্তপাত হয়। প্রস্রাবের সঙ্গে অতিরিক্ত রক্ত বেরিয়ে যায়। তাই ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া সারার পরেও লিভারের ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু এ বার ডেঙ্গির ক্ষেত্রেও তা করতে হচ্ছে, যা কার্যত অভূতপূর্ব। “গত ক’বছর কলকাতায় ডেঙ্গি-রোগীদের লিভারের ওষুধ দিতে হয়নি। এ বার হচ্ছে। এর চরিত্র আলাদা।” বলছেন অমিতাভবাবু। লিভার-বিশেষজ্ঞ অভিজিৎ চৌধুরীর মন্তব্য, “এত দিন ডেঙ্গিতে লিভারের ক্ষতি হচ্ছিল না। এখন হচ্ছে। শারীরিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে রোগ নির্ণয়ে সমস্যা হচ্ছে।” ডেঙ্গি-জীবাণুর আক্রমণের চরিত্র এ ভাবে বদলে যাওয়ার কারণ কী?
বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, এটা ভাইরাস ও মানবশরীরের সংঘাতের ফল। তাঁদের বক্তব্য: গত পাঁচ-সাত বছর ধরে কলকাতায় ডেঙ্গি ছড়াচ্ছে। অর্থাৎ এর জীবাণু মহানগরের পরিবেশে রয়ে গিয়েছে। বেঁচে থাকার তাগিদে ওই সময়ের মধ্যে ভাইরাস নিজেদের বদলেছে (মিউটেশন)। মানুষের শরীরও পরিবর্তিত ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচতে নিজের মতো করে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলছে। মানুষের দেহ যেমন ভাবে নিজেদের বদলে নিয়ে ভাইরাস প্রতিরোধের বর্ম তৈরি করছে, তেমন সেই বর্ম ভেদ করতে জীবাণুও তৈরি করে ফেলছে নিত্যনতুন অস্ত্র।
নতুন অস্ত্র প্রয়োগের প্রতিক্রিয়াও হচ্ছে নতুন। মুশকিলে পড়ছেন চিকিৎসকেরা। স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা, চিকিৎসক-গবেষক অমিয় হাটি জানাচ্ছেন, ডেঙ্গির সঙ্গে ম্যালেরিয়ার আশঙ্কা সব সময়ই থাকে। সে ক্ষেত্রে শরীরের ভিতরে দু’টো জীবাণুর মিলিত প্রতিক্রিয়ায় চিকিৎসায় সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক।
হচ্ছেও। অমিয়বাবু বলেন, “একই মানুষকে ডেঙ্গিবাহী মশা আর ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশা একই দিনে বা অল্প ব্যবধানে কামড়ালে তিনি দু’টো অসুখেই আক্রান্ত হবেন। গত ক’বছরে ছ’শো ডেঙ্গি রোগীর মধ্যে এমন চল্লিশ জনকে পেয়েছি, যাঁদের ম্যালেরিয়াও হয়েছিল।” তাঁর দাবি, ডেঙ্গির সঙ্গে চিকুনগুনিয়ারও আশঙ্কা যথেষ্ট। তবে অমিতাভবাবু জানিয়েছেন, এ বছর এখনও একই রোগীর শরীরে ডেঙ্গি ও ম্যালেরিয়া পাননি। তিনি বলেন, “জ্বর নিয়ে যাঁরা আসছেন, তাঁদের ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া, তিনটেরই পরীক্ষা করাতে বলছি। লিভার, লিম্ফ গ্রন্থির অবস্থাও যাচাই করছি।”
এত সব পরীক্ষার পরই তাঁরা এ বারের ডেঙ্গির ‘বিচিত্র’ আচরণ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন বলে জানাচ্ছেন অমিতাভবাবু।
|
জ্বর যন্ত্রণা |
সাধারণ উপসর্গ |
• প্রথমে কম, পরে হঠাৎ তীব্র জ্বর
• মাথায়, চোখের পিছনে, গাঁটে ব্যথা
• গায়ে লাল র্যাশ, চোখ লাল
• কখনও পেটে অসহ্য যন্ত্রণা, বমি
• শরীরে জলের পরিমাণে টান
• বিভিন্ন অঙ্গ থেকে রক্তপাত (হেমারেজিক হলে) এ বার বাড়তি
• তলপেটের ডান দিকে ব্যথা
• বুকে-পেটে জল জমা
• লসিকা গ্রন্থিতে যন্ত্রণা
• কোষ্ঠকাঠিন্য, পরে ডায়েরিয়া
• লিভারে ক্ষতি, হেপাটাইটিস |
|