লজ্জা, ঘৃণা, ভয়। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজের মনে একযোগে তিনটি অনুভূতিই জাগিয়ে তুলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সমাজ মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি বিমুখ হয়ে উঠছে। বহু নীরব কণ্ঠ ক্রমশ সরব হচ্ছে। অনেকেই আর্তনাদ করছেন, ‘এ কী হল! এমনটা তো চাইনি। এ কাকে আনলাম আমরা? কাদের আনলাম?’ অম্বিকেশ মহাপাত্রের পরে শিলাদিত্য চৌধুরী, একের পর এক সহনাগরিক রাষ্ট্রীয় ত্রাসের শিকার হয়ে চলেছেন। ইন্টারনেট-বাহিত রকমারি সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটের দৌলতে নিন্দা-প্রতিবাদের তরঙ্গ উত্তরোত্তর সঞ্চারিত হচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর প্রশাসনের আচরণে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হিসেবে আমাদের লজ্জা, ঘৃণা এবং, বিশেষত, ভয় বোধ করার যথেষ্ট কারণ আছে। ক্ষমতাবানের অসহিষ্ণুতা এবং যথেচ্ছাচারের একটা নতুন আবহ পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়েছে, পঁয়ত্রিশ বছরের অপশাসনের দোহাই দিয়ে সেই সত্যকে অস্বীকার করা যাবে না। বস্তুত, সেই অপশাসনের অবসান ঘটিয়ে রাজ্যে একটা যথার্থ উদার, মুক্ত, সহিষ্ণু রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, তিনি সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, তাঁর রাজত্বের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একটা আতঙ্কের পরিবেশ কায়েম হয়েছে এই রাজ্যে। বেসুর গাইলেই আপনি শত্রু বলে চিহ্নিত হতে পারেন, এই আতঙ্ক। শিলাদিত্য চৌধুরী সেই ভয়ের অনপনেয় প্রতীক। এ সত্য দুর্ভাগ্যজনক। উদ্বেগজনক।
কিন্তু এই ঘটনাপরম্পরায় কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তিত হওয়ার কোনও কারণ আছে? এই নিন্দা-প্রতিবাদ কি তাঁর কোনও ক্ষতি করবে? অন্য কোনও ক্ষতির কথা বলছি না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতিক, তাঁর রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের অঙ্কটাই এখানে বিচার্য, আর কিছু নয়।
প্রথমে লোকসানের ব্যাপারটা দেখা যাক। প্রতিবাদ শুনলেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠে, প্রেসিডেন্সির ছাত্রী, যাদবপুরের মাস্টারমশাই এবং নয়াগ্রামের কৃষক, সবাইকে এক ধার থেকে মাওবাদী বা ষড়যন্ত্রী বলে চিহ্নিত করে মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই সমাজের একটা অংশের কাছে অপাংক্তেয় হয়ে উঠছেন, আমরা যারা সেই অংশের অংশীদার তারা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছি। কিন্তু আমরা কে? পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে, বিশেষ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কোষাগারে আমাদের দাম কতটুকু? আমরা নিজেদের খুব ওজনদার ভাবতে ভালবাসি, কিন্তু সেটা আত্মশ্লাঘা বই কিছু নয়। বামফ্রন্টের শেষ অঙ্কে নাগরিক সমাজ ঘুম ভেঙে উঠে ঈষৎ সরব ও সচল হয়েছিল, তার একটা ফলও নিশ্চয়ই হয়েছিল, কিন্তু তা থেকে এমন ধারণা তৈরি করে নিলে মস্ত ভুল হবে যে, আমরা দু’চারটে মিছিল করলে আর টিভি চ্যানেলে সান্ধ্য আসরে পবিত্র ক্রোধ ব্যক্ত করলে আর ফেসবুক-টুইটারে শোরগোল তুললেই অমনি মুখ্যমন্ত্রীর পদতলে মেদিনী কম্পিত হবে। কিস্সু হবে না। যে মানবজমিন আবাদ করে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন, তার হিসেব আলাদা, সেই জগৎ ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ নিয়ে মাথা ঘামায় না।
তা ছাড়া, বামফ্রন্টের জমানাতেও শহরের বাইরে, বস্তুত কলকাতার বাইরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেমন ছিল, সেটা ভয়ানক গোপন কোনও খবর নয়, আমরা আমাদের মহানাগরিক মুক্তাঞ্চলে বসে তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাইনি, কিন্তু ‘পিপল লাইক দেম’ সেই ইতিহাস ভুলে যাননি, তাই নতুন জমানায় কণ্ঠরোধের উদ্যোগ নিয়ে তাঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই। বরং টেলিভিশনের ইংরেজি চ্যানেলে অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে ‘আমাদের দিদি’ নামী-দামি সাংবাদিকের মুখের ওপর ‘এরা সব মাওবাদী, এদের চক্রান্ত আমি সহ্য করব না’ গোছের বাক্যবাণ ছুড়ে দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলে তাঁরা গৌরবান্বিত বোধ করতে পারেন, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্পে গ্রামবাসীরা যেমন ‘আমাদের মাস্টার জিতেছে’ বলে গর্বিত আহ্লাদে আটখানা হয়েছিলেন।
এবং, মুখ্যমন্ত্রী এ-ও জানেন যে, ‘পিপল লাইক আস’ বেশি দিন টানতে পারব না, দু’এক সপ্তাহ ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না’ বলে কান্নাকাটি করে দিব্যি মিইয়ে যাব, তত দিনে অন্য তর্ক এসে যাবে না এলেও অণ্ণা হজারে তো আছেনই নতুন টপিক নিয়ে আপনি ঝাঁ-চকচকে কমেন্ট দেবেন, আমি ‘লাইক’ করব। এমনকী, কে বলতে পারে, ইতিমধ্যে হয়তো দেখা যাবে কোনও এক বেলা দ্বিপ্রহরে মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর প্রতিনিধি গিয়ে শিলাদিত্য চৌধুরীর পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর ফসলের খবর নিচ্ছেন, সস্তায় সারের জোগান দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন, দেখতে দেখতে নেগেটিভটা পজিটিভ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং, মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চিত, লোকসান যৎসামান্য।
আর লাভ? লাভ আছে। মস্ত লাভ। এই যে মুখ্যমন্ত্রী উঠতে বসতে ‘মাওবাদী’ ‘মাওবাদী’ বলে পাড়া মাথায় করছেন, তার ফলে জনমানসে একটা ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে যে, মাওবাদীদের দমন করতে তিনি বদ্ধপরিকর। এই ধারণাটা তাঁর পক্ষে বিশেষ উপকারী। মনে রাখা দরকার, বামফ্রন্ট জমানার একটা পর্বে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থানের সময়, তাঁর দলের সঙ্গে মাওবাদীদের যোগাযোগ নিয়ে বিস্তর শোরগোল উঠেছিল, বামফ্রন্ট স্বাভাবিক ভাবেই তা নিয়ে প্রবল প্রচার চালিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বোধ নন। তিনি অচিরে বুঝতে পারেন, এই পরিস্থিতি বিপজ্জনক, কারণ মাওবাদীদের সঙ্গে পরোক্ষ যোগাযোগও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে, বিশেষ করে যখন তাদের হিংস্রতা সাধারণ মানুষকে তাদের প্রতি সম্পূর্ণ বিরূপ করে তুলেছে, মাওবাদের আদর্শের প্রতি কিছু মানুষের ‘তাত্ত্বিক’ সমর্থন দিয়ে যে বিরূপতার তল পাওয়া যাবে না। অতএব রাজ্যবাসীর চোখে নিজেকে মাওবাদীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে রাজনৈতিক ভাবে জরুরি ছিল।
কিষেনজির মৃত্যু সেই প্রতিষ্ঠাকে বহুলাংশে নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু রাজনীতির পরিসরে একটা ধারণা প্রতিষ্ঠা করলেই চলে না, তাকে লালন করতে হয়। গত কয়েক মাসে বিভিন্ন উপলক্ষে বার বার মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর তীব্র বিষোদ্গার সেই কাজটি করেছে। মানুষের মনে যাঁরা তাঁর অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদে মুখর তাঁদের মনেও এই ধারণা দৃঢ়মূল হয়েছে যে, মুখ্যমন্ত্রী মাওবাদীদের চরম শত্রু মনে করেন। তিনি সত্যিই তা মনে করেন, না কি জনমানসে এমন একটি ধারণা নির্মাণ করবেন বলে থেকে থেকে ‘মাওবাদী’ বলে শোরগোল তুলছেন, সেই জল্পনা নিষ্ফল, কারণ রাজনীতিকের মনের খবর দেবা ন জানন্তি। কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাওবাদ-বিরোধী ভাবমূর্তি তৈরি হলে তাঁর রাজনৈতিক লাভ বিস্তর। দু’এক জন শিলাদিত্য চৌধুরীর লাঞ্ছনা নিয়ে দু’চার হাজার প্রতিবাদী টুইট-এ রাজনীতির কিছু যায় আসে না। মুখ্যমন্ত্রী জানেন, টুইট মানে পাখির ডাক। কিচিরমিচির।
প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রীর এই মাওবাদী জুজু প্রদর্শন নিয়ে সি পি আই এমের নায়করা বিশেষ উচ্চবাচ্য করেননি। এই নীরবতা কেবল তাঁদের দলটির হালভাঙা পালছেঁড়া দশার কারণে নয়, আসলে তাঁরাও জানেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এমন কিছু না করাই শ্রেয়, যা পরোক্ষেও মাওবাদীদের প্রতি সমর্থন হিসেবে গণ্য হতে পারে।
শিলাদিত্য চৌধুরীর প্রতি যে অন্যায় হয়েছে, তার প্রতিবাদের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এ ধরনের যে কোনও ঘটনায় প্রতিবাদী হয়ে ওঠার কাজে নাগরিক সমাজের দায়িত্বও প্রশ্নাতীত। সেই সমাজকে এমন আরও অনেক ঘটনার জন্যই এখন প্রস্তুত থাকতে হবে, প্রতিবাদে নামতে হবে। কিন্তু সেই প্রতিবাদের আশু সাফল্য নিয়ে বেশি আশা করলে আশাভঙ্গের বেদনাও একটু বেশি ভোগ করতে হবে। রাজনীতি বড় কঠিন ঠাঁই। |