সম্পাদক সমীপেষু...
‘বিবেক’ বলতে কী বুঝব, সেই প্রশ্ন অতি জটিল
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বিবেক মানে কী? তা কি কোনও বায়বীয় বস্তু’ (১-৮) শীর্ষক চিন্তা-উদ্দীপক লেখাটি প্রসঙ্গে এই চিঠি। এক লজ্জাকর নারীনিগ্রহের ঘটনাকে উপলক্ষ করে যে গুরুতর প্রশ্নটি সুনীল তুলেছেন, তা প্রতিটি সচেতন মানুষকেই ভাবাবে। এ জাতীয় যে কোনও ধারণাত্মক শব্দের অর্থ বিষয়ে ধন্দে পড়লে তা কাটানোর জন্য শর্টকাট চেষ্টা হল, প্রথমে অভিধানের ও পরে মহাজনদের শরণ নেওয়া। সেই চেষ্টারই একটি বয়ান সংক্ষেপে জানাচ্ছি।
প্রথমত, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানে দেখি যে, ‘বিবেক’ শব্দটির কোনও ‘বিবেকী’ অর্থই দেওয়া নেই। যা দেওয়া আছে তা হল: ‘১ বিলক্ষণ ভাব, পৃথগাত্মতা, ২ বিভাগ, ৩ বিচার, বিবেচন ৪ প্রকৃতি পুরুষের বিশেষ জ্ঞান, ৫ জ্ঞান, বোধ’ ইত্যাদি। ভারতীয় চিন্তায় ‘বিবেক’-এর এই জটিল ‘বিচ্’ ধাতু (‘বিচার করা’)-নির্ভরতা দেখে বেশ ঘাবড়ে যাই। কারণ, বিবেক হল সোজা কথায়, মানবিক নীতিবোধ। কিন্তু ‘বিচার করা’ আর ‘নীতিবোধ’ কি সমার্থক? ‘জ্ঞান, বোধ’ ইত্যাদিও কোনও ভাবেই বিবেক-এর উপযুক্ত প্রতিশব্দ নয়।
এ বারে আমি জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’ দেখি, এবং সেখানে এই পাই: ‘বিবেক মানব হৃদয়ের মধ্যে থাকিয়া যে অনির্বচনীয় পদার্থ মানুষকে সৎকার্যে উৎসাহ এবং কুকার্যে নিরুৎসাহ দান করে, যা অন্তরের মধ্যে সৎকার্য হেতু সন্তোষ এবং কুকার্য হেতু গ্লানি উৎপাদন করে, conscience।’ এই মরিয়া শব্দার্থটি দেখে সন্দেহ হয়, তা হলে বিবেক কি সত্যিই একটি বায়বীয় বস্তু, যাকে ধরার জন্য এত বড় শব্দজাল বিছাতে হল? ‘অনির্বচনীয় পদার্থ’ শুনে তো আধুনিক সমাজ বিদ্রুপের অট্টহাসি হাসবে! তবু, নৈতিক দর্শনের এই সাবেকি সংজ্ঞাটি জ্ঞানেন্দ্রমোহন যত্ন করে অভিধানে রাখলেন, এ জন্য তিনি ধন্যবাদার্হ। এই বিবেকার্থ-কে কেন্দ্র করে হরিচরণের সঙ্গে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের মানসিকতার একটি তফাতও যেন-বা আভাসিত হল।
গুয়াহাটি, জুলাই ২০১২। এই যুবকদের কাছে বিবেক শব্দটি অর্থহীন।
অতঃপর এই পোস্ট-কলোনিয়াল যুগেও ‘নেটিভ’-দের অগতির গতি সেই ‘কনসাইজ অক্সফোর্ড ডিকশনারি’-তে পেলাম: ‘conscience a person’s moral sense of right or wrong’। নাস্তিক মননে এই ‘মর্যাল সেন্স’ বা নীতিবোধ একটি হৃদয়বৃত্তির ব্যাপার, বুদ্ধিবৃত্তির নয়। এই বোধ অতীন্দ্রিয় এবং স্পিরিচুয়াল। এটি ক্রমোন্নত মানবচৈতন্যের একটি জন্মগত গুণ আমরা এ কথাও ভাবতে পারি। কিন্তু এখানে, এই বিবেকের প্রশ্নে, আধুনিকতার দর্শনে একটি কঠিন স্ববিরোধ আছে। সেটি এই যে, ঈশ্বর না-থাকলে মানব-বিবেকের ভিত্তিটাই দুর্বল হয়ে যায়। কারণ, নাস্তিক-জড়বাদী-বিজ্ঞানবাদী আধুনিকতার মননে মানুষের আত্মরক্ষা-বংশরক্ষার জন্তু রূপটাই একমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য। তার নৈতিক মূল্যবোধের কোনও শিকড়ই সেই মননভূমিতে খুঁজে পাওয়া শক্ত। সে জন্য আধুনিকতার দর্শনে জন্তু-মানুষের ‘ঐশী চেতনা’-র স্ববিরোধটি একটি আত্মঘাতী বোমার মতো জেগে থাকে। আধুনিক মানুষের সংকট হল তাত্ত্বিক বিচারে বায়বীয়, কিন্তু হৃদয়বেদনায় গুরুভার এই ‘বিবেক’-এর সংকট।
এ বারে দেখি যে, বিবেক-প্রসঙ্গে দু’চার জন মহাজন কী বলছেন। প্রথমেই বলি, দার্শনিক কিয়ের্কেগার্দ-এর কথা। নীতিবোধের আধ্যাত্মিক উৎসে বিশ্বাসী এই দার্শনিক বলছেন: ‘ঈশ্বর না থাকলে মানুষের বিবেক বলেও কিছু থাকে না। কেননা বিবেকের মাধ্যমেই ঈশ্বর ও ব্যক্তিমানবের সম্পর্ক তৈরি হয়। সেই জন্যই বিবেকের ওপর চাপ এত ভয়ানক ব্যক্তিমানবকে তা মনে করিয়ে দেয় ঈশ্বরের অপরিমেয় গুরুত্ব’। গভীর বিবেক-দংশনের অভিজ্ঞতা যাঁরই আছে, তাঁকেই স্পর্শ করবে এই ‘ঈশ্বরের অনন্ত ভার’-এর রূপকটির ‘গভীর ব্যঞ্জনা’, তিনি যদি নাস্তিক হন, তবুও।
এ বারে বলি, আধুনিকতার অন্যতম প্রধান পুরোহিত ফ্রয়েডের কথা। মানবমনের ত্রি-স্তরিক ‘ইদ-ইগো-সুপারইগো’ মডেলটির প্রবক্তা তিনি। যেখানে ‘ইদ’ মানে নির্জ্ঞান মনের অন্ধ প্রবৃত্তি, ‘ইগো’ মানে অহং-চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তি এবং ‘সুপারইগো’ মানে নৈতিক বোধ বা হৃদয়বৃত্তি। এই মডেলটির ভিতরে ‘বিবেক’-এর স্বরূপ কী? ফ্রয়েড বলেছেন যে, সভ্যতা কী করে ব্যক্তির আগ্রাসী প্রবৃত্তিকে দমন করে রাখে, তার উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় ব্যক্তির বিবর্তনকে অনুধাবন করলে। জানা যায় এমন একটি আশ্চর্য দমনকারী প্রক্রিয়ার কথা, যা আমরা ভাবিই না কখনও। অথচ সেটি খুবই সরল আর সহজবোধ্য। বহির্জগতের প্রতি ব্যক্তিমনের এই আগ্রাসন দমিত হয় যে অদ্ভুত প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে তা হল এই: সেই আগ্রাসনকেই দিক ফিরিয়ে অন্তর্ধাবী এবং অভ্যন্তরীণ করে নেওয়া হয়।
বস্তুতপক্ষে, সেই আগ্রাসনের যা উৎস, সেই ইগো-র দিকেই সেই আগ্রাসনকে চালিত করা হয়। তখন ইগোর একটি বিশিষ্ট অংশ সুপার-ইগো তার দখল নেয়, এবং সেই সুপার-ইগো, ‘in the form of conscience, exercises the same propensity to harsh aggressiveness against the ego that the ego would have liked to enjoy against others. The tension between the strict superego and the subordinate ego we call that the sense of guilt, it manifests itself in the need for punishment.’। এ ভাবেই সভ্যতা ব্যক্তিমনের আগ্রাসী প্রবৃত্তিকে ‘দমিত ও নিরস্ত্র’ করে এবং সেই পরাস্ত ইগো-র ভিতরে বিবেকের একটি নজরদারি দুর্গ প্রতিষ্ঠা করে।
সবশেষে বলি কান্ট-এর কথা। তিনি ফ্রয়েডের পূর্বসূরি এবং মানবচৈতন্যের জন্মগত গুণাবলিতে বিশ্বাসী। তিনি বললেন যে, বিবেক হল মানুষের একটি ইন্সটিংক্ট, যার অকাট্য নৈতিক নির্দেশে মানুষ নিজেকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তার নিজের কৃতকর্মের ন্যায় ও অন্যায়ের কথা বিচার করে। এই ক্ষমতার কারণেই বিবেক একটি ইনস্টিংক্ট, তা শুধু মাত্র একটি ‘ফ্যাকাল্টি অব জাজমেন্ট’ নয়। (কান্ট কর্তৃক এই ‘ইন্সটিংক্ট’ শব্দটির প্রাক-ফ্রয়েডীয় ওজস্বী প্রয়োগে বিস্মিত হতে হয়!) কান্ট অন্যত্র ‘মর্যালিটি’ বিষয়ে এই অমূল্য কথাটি বললেন: ‘Morality is not properly the doctrine how we should make ourselves happy, but how we should become worthy of happiness.’ এই উক্তিটির সামনে আমাদের এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াতে হয়। ভাবতে হয় যে, আমরা আধুনিকেরা যে চরম ব্যক্তিবাদী-অবচেতনবাদী মানসিকতার ধ্বজা তুলে বাজার-সংস্কৃতির ভিতরে ভোগসুখের সন্ধানে ছুটে চলেছি, সেই মানসিকতায় আবদ্ধ আমরা কি আদৌ ‘ওয়ার্দি অব হ্যাপিনেস’? আজকের এই বল্গাহীন মৌজ-মস্তি-বিনোদনের জমানায় এটিই এক বিষণ্ণ বিবেক-প্রশ্ন।
বাংলা ভাষার কথা বলবেন কে?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘যা দেখি, যা শুনি, মনে মনে কথা বলি’ কলমের (১-৮) নিবন্ধটি পড়ে এবং দেবেশ রায়ের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, বিমল লামার ‘নুন চা’ উপন্যাসটি সুলিখিত। নেপালি ভাষাভাষী লেখকের পক্ষে কৃতিত্বটি কম নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং দেবেশ রায় দু’জনেই বাংলা উপন্যাসের ভালমন্দ বিচারের যোগ্য অধিকারী। আমরা যারা পাঠের সুযোগ পাইনি এখনও, অবশ্যই বইটির খোঁজ করব।
আমার বলার বিষয় অন্য। সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গই দেশের একমাত্র প্রদেশ যেখানে বাংলা ভাষা আদৌ না-পড়ে যে কেউ উচ্চশিক্ষার দরজা পেরোতে পারে। এখানে বাংলা আবশ্যিক পাঠ্য নয়। ব্যক্তিগত ভাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং অন্যান্য ভাষা আন্দোলনের সংগঠন বিগত বামফ্রন্ট সরকারের কাছে ক্লাস এইট পর্যন্ত বাংলা আবশ্যিক করার আবেদন রেখেছিলেন। চৌত্রিশ বছরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা আবেদনে সাড়া দেননি। বর্তমানে তেরো-চোদ্দো মাসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারও এ ব্যাপারে নীরব। জানি না, দলীয় রাজনীতির পারস্পরিক গোলাগুলির ফাঁদে কেন বাংলা ভাষা আহত হচ্ছে।
সত্যি কথা, ভাষা শুধু সরকারি আইনের আওতায় বাঁচে না সামাজিক শক্তির সহায় দরকার। তবু বর্তমান গণতন্ত্রে সরকারি শক্তির বিশেষ ভূমিকা আছে। দার্জিলিং পাহাড়ের জি টি এ-র আওতায় স্কুলগুলোর কোথাও বাংলা পড়ার সুযোগ আছে কি না জানি না। বলতে দ্বিধা নেই, বহু দিন ধরেই আমাদের পশ্চিমবঙ্গের যুযুধান রাজনৈতিক পরিবেশে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য দ্বিতীয় স্তরের নাগরিকদের মর্যাদায় পরিণত হয়েছে। অথচ, আধুনিক সমাজতাত্ত্বিক গবেষকরা বলছেন, ভাষা ও সাহিত্য কোনও জাতির উন্নয়নের অন্যতম মাপকাঠি। এ নিয়ে সরব হবেন কারা? পথই বা বাছবেন কে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.