আমরা বিশ্বাস করি, নিজেদের মতো নায়ক তৈরি করে নিই।
সেই নায়ক
যখন বিশ্বাস ভাঙেন, অসহায় লাগে বইকি। লিখছেন
অমিতাভ গুপ্ত |
ল্যান্স আর্মস্ট্রংকে আমি অতি সামান্য চিনতাম। খবরের কাগজের খেলার পাতায় অনাগ্রহী চোখ বোলালে যতখানি চেনা যায়, বড় জোর ততটুকুই। তবুও, তাঁর সঙ্গে আমার একটা বিশ্বাসের সম্পর্ক ছিল। টুইটারে দেখলাম, শুধু আমার নয়, অনেকেরই। একটা আলগোছে জড়িয়ে থাকা বিশ্বাস। এক ধরনের ভাল লাগা একটা লোক আছে, যে যাবতীয় প্রতিকূলতাকে হারিয়ে শৃঙ্গ জয় করতে পারে। লোকটা পারে, শুধু এই কারণেই ভাল লাগা, ভরসা।
ঠিক জানি না, ‘সীমাবদ্ধ’-য় হয়তো টুটুলের তার জামাইবাবু শ্যামলেন্দুর ওপর এ রকমই একটা ভরসা ছিল। কলকারখানার দুনিয়াতেও ইংরেজি সাহিত্য পড়া মনটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে সে, সেই ভরসা। সেই ভরসায় লেনদেনের সম্পর্ক ছিল না, টুটুলের জীবনের কোনও নোঙর বাঁধা ছিল না শ্যামলেন্দুর সৎ থাকায়। সে ভরসা কেবল মনকে বলা হয়, হয়। একটা লোক নিজের ভিতরটাকে না মেরেও সফল হতে পারে।
এ ভাবেই তো নায়ক তৈরি হয়।
সেই নায়কের সঙ্গে আমাদের শুধু বিশ্বাসের সম্পর্ক।
অথবা, যার সঙ্গে আমাদের বিশ্বাসের সম্পর্ক, শুধুমাত্র সেই বিশ্বাসটুকুর কারণে সে আমাদের কাছে নায়ক হয়ে যায়। নিতান্ত ব্যক্তিগত নায়ক। কিন্তু, এমন এক জন, জানি যে কখনও আমার বিশ্বাস থেকে সরে আসবে না। কখনও নাড়িয়ে দেবে না আমায় বলবে না, এত দিন যা জেনে এসেছিলে, সব ভুল। এ বার নতুন করে দেখো।
এই টুকরো টুকরো বিশ্বাস জড়ো করেই আমাদের বেঁচে থাকা। অন্যকে চেনা। নিজেকেও।
সেই বিশ্বাসের জিগ্স পাজল থেকে দু’একটা টুকরো সরে গেলেই বেঁচে থাকার খেলাটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায় না? |
আমার এক আপনজন আজন্ম বামপন্থায় বিশ্বাস করেছিলেন। ১৯৯১ সালে যখন তাঁর ছাপ্পান্ন বছর বয়স, তখন ভেঙে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর পাঁচ জনের কাছে নেহাতই একটা খবর। কিন্তু, যাঁর বিশ্বাসের ভিত গাঁথা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মাটিতে, দেশে পার্টি ভাগ হওয়ার সময়েও যাঁর সোভিয়েতে বিশ্বাস বিন্দুমাত্র নড়েনি জানি না, তাঁর কাছে হয়তো এটা এক রকম দুনিয়া শেষ হয়ে যাওয়াই ছিল। তিনি নিঃশব্দে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই বিশ্বাসের মৃত্যুর পর কি জীবন এক রকম ছিল? থাকা সম্ভব?
অথবা, নিতান্ত বালক বয়েস থেকে যে গায়ককে প্রায় দেবজ্ঞানে ভালবেসে এসেছিলাম, পরিবহণ ধর্মঘটের দিন যাঁর গান শোনার জন্য দুপুরের রোদে হেঁটেছিলাম প্রায় দশ কিলোমিটার, বড় হয়ে যখন দেখি, তিনিই কথা বলেন ফ্যাসিবাদীর গলায়, তখন ধাক্কা তো লাগেই।
হয়তো প্রতিটা বিশ্বাসের মধ্যেই নিহিত থাকে একটা মিথ্যে। মিথ্যে আশা। ল্যান্স আর্মস্ট্রং তো আমায় কখনও তাঁকে বিশ্বাস করতে বলেননি। শ্যামলেন্দু কখনও টুটুলকে কথা দেয়নি যে সে হারিয়ে যাবে না কর্পোরেট দুনিয়ার গোলকধাঁধায়। আমি বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম। টুটুল বিশ্বাস করে নিয়েছিল। আমরা বিশ্বাস করে নিই। কারও মধ্যে মহত্ত্বের কোনও সম্ভাবনা দেখলে আমরা সেই সম্ভাবনাকে আর সন্দেহ করি না। আমরা তাকেই সত্যি বলে জানি। কারণ, এই সত্যি বলে জানা ছাড়া, এই বিশ্বাস ছাড়া বাঁচা যায় না। রূপকথা যে শুধু শৈশবের গল্প, কে বলল? এক জন লোক, ক্যান্সারকে হারিয়ে ফিরে আসতে পারে স্বাভাবিক জীবনে, বার বার জিতে নিতে পারে কঠিনতম শৃঙ্গ এই রূপকথা না থাকলে নিজের ভিতরে পারার ইচ্ছেটা শ্বাসবায়ু কোথায় পাবে?
এ রকম প্রতিটা বিশ্বাসের মধ্যে একটু করে শৈশব জড়িয়ে থাকে। বিশ্বাস অপাপবিদ্ধ বলেই হয়তো। একটা করে বিশ্বাস ভেঙে যায়, এক এক জন মানুষকে মাপে ছোট হয়ে যেতে দেখি, আর একটু করে শৈশব দূরে চলে যেতে থাকে। এ ভাবেই তো আমরা বড় হই। ‘শুভনাস্তিক’ কথাটা ছোটদের অভিধানে নেই ওটা প্রাপ্তবয়স্ক-দুনিয়ার শব্দ। অনেকগুলো বিশ্বাস না ভাঙলে সিনিক হওয়া যায় না।
সব বিশ্বাস ভাঙলে এক রকম আঘাত লাগে না, ঠিক। আজন্ম বামপন্থায় বিশ্বাসী মানুষের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়া আসলে একটা জন্মের শেষ। ল্যান্স আর্মস্ট্রং যখন তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা ডোপিংয়ের অভিযোগ কার্যত স্বীকার করে নিলেন, সেই আঘাতের সঙ্গে এর তুলনা চলে না। তবুও, আর্মস্ট্রংয়ের এই ছোট হয়ে যাওয়া, রূপকথার নায়ক থেকে আর পাঁচ জন মানুষ হয়ে যাওয়ায় যে কষ্ট হয়, তাকেই বা অস্বীকার করি কী করে? সেটাও তো একটা বিশ্বাসের মৃত্যুই।
শনিবার আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় যেখানে আর্মস্ট্রংয়ের খবরটা ছিল, তার ঠিক নীচে খড়্গপুরের একটা বাচ্চা ছেলের কথা ছিল। সেই তুহিনের হাত-পা তার অ-বশ। সে তবু হার মানেনি। সে মুখে কলম ধরে লেখে, বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এক ফরাসি সাংবাদিকের জীবন তাকে সাহস দিয়েছে। তুহিন তো বিশ্বাসই করেছে তাঁর ওপর। হয়তো সে ল্যান্স আর্মস্ট্রংকেও বিশ্বাস করেছিল, আমাদের মতোই। এই বিশ্বাসভঙ্গ যদি তাকে, তার মতো আরও অনেককে শেখায়, কাউকে বিশ্বাস করো না, কেউ সেই বিশ্বাসের যোগ্য নয়? বিশ্বাসটুকুই না করতে পারলে অন্য তুহিনরা কি মুখে কলম ধরে বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারবে?
লিখতে লিখতেই মনে হল, যদি কখনও জানাও যায় যে তুহিন যে সাংবাদিককে তার জীবনের ধ্রুবতারা মেনেছিল, সেই সাংবাদিক আসলে এক প্রতারকমাত্র, তাতেই বা কি? তাতে কি তুহিনের লড়াইটা মিথ্যে হয়ে যাবে? ওই সাংবাদিকের ‘জীবন’ থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণায় তুহিন নিজের জীবনে যা করে ফেলবে, সেগুলো কি ওর থেকে কেড়ে নেবে কেউ?
আসলে বোধ হয় নিজে ছাড়া সবাই ‘বাইরের লোক’। নিজের ভিতরের বিশ্বাসটাকে বিশ্বাস করতে পারাই আসল। |