কলিকাতা নামক শহর, এবং যে রাজ্যটি এই শহরের উপর আপ্রাণ নির্ভর করিয়া বাঁচে সেই পশ্চিমবঙ্গ যে ক্রমে তলাইয়া যাইতেছে, তাহাতে সংশয় নাই। প্রশ্ন হইল, এই অধোগতিই কি একমাত্র ভবিতব্য? নাকি, এই শহর, এবং এই রাজ্য, কোনও এক মুহূর্তে ঘুরিয়া দাঁড়াইতে পারে, হৃত গৌরব ফিরিয়া পাইতে পারে? কলিকাতা সফরে আসিয়া মার্কিন অধ্যাপক এবং বিদেশ নীতি বিশ্লেষক ওয়াল্টার রাসেল মিড বলিলেন, ঘুরিয়া না দাঁড়ানোই আশ্চর্যের। কারণ, দুনিয়ার ক্ষমতার মানচিত্র যে ভাবে পুনর্নিমিত হইতেছে, তাহাতে কলিকাতা আর প্রান্তে নহে, একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। মিড এশিয়ার ক্ষমতায়নের কথাই উল্লেখ করিলেন। দুনিয়ার অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্রটি যে ক্রমেই পূর্ব এশিয়ায় সরিয়া আসিতেছে, তাহা সর্বস্বীকৃত। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সহিত ভারতের বাণিজ্য বাড়িবে। সেই বাণিজ্যের পথে ভারতের বৃহত্তম শহর কলিকাতা, ফলে এই শহরের গুরুত্বও বাড়িবে। কিন্তু, সেই গুরুত্বকে একবিংশ শতকের অর্থনীতির কেন্দ্রে থাকা বলিলে তাহা অতিকথন তো হয়ই, কেন্দ্রের ধারণাটির প্রতিও অবিচার করা হয়।
কেন্দ্র একটি ধারণা। তাহার সহিত ভূগোলের যোগ আছে বটে, কিন্তু ভূগোলের জ্যামিতি যাহাকে ‘কেন্দ্র’ বলে, প্রকৃত প্রস্তাবে তাহা কেন্দ্র না-ই হইতে পারে। আধুনিক অর্থনীতি ভৌগোলিক পরিসরের সীমানা ছাড়াইয়া বৌদ্ধিক পরিসরে পৌঁছাইয়াছে। কাজেই, তাহার ক্ষেত্রে ভৌগোলিক কেন্দ্র স্বভাবতই আর গুরুত্বপূর্ণ নহে। কিন্তু, যে যুগে তথ্যপ্রযুক্তি বা বিশ্ব-গ্রাম কল্পনারও অতীত ছিল, সে যুগেও কি ভূগোলই কেন্দ্র নির্দিষ্ট করিয়া দিত? ইংল্যান্ডের উদাহরণটি তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্ব মানচিত্রে ইংল্যান্ড যে মধ্যাসনটি অধিকার করিয়া আছে, তাহা কি ভূগোলের নির্দেশ, নাকি ভূগোলকে এই পথে গড়িয়া লইবার আর্থিক, সামরিক এবং বৌদ্ধিক সামর্থ্য ইংল্যান্ডের ছিল বলিয়াই মানচিত্র এই রূপ হইয়াছে? যে মানচিত্রে ইংল্যান্ড পৃথিবীর মধ্যমণি, সিলিকন ভ্যালি সেই মানচিত্রে নিতান্তই প্রান্তিক। অথচ, যে দুনিয়া তথ্যপ্রযুক্তির উপর নির্ভর করিয়া বাঁচে, তাহার নিকট সিলিকন ভ্যালিই কেন্দ্র। বৌদ্ধিক পরিসর ভূগোল মানে না। যেমন মানে নাই ১৯২০-র দশকে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হৃতগৌরব বঙ্গ প্রদেশকে কল্পনার কোনও বিস্তারেই ভূগোলের মাপকাঠিতে পৃথিবীর কেন্দ্র বলিত না। অথচ, এই প্রদেশে বসিয়াই সত্যেন্দ্রনাথ বসু যখন বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিকস-এর ভিত্তি নির্মাণ করিতেছিলেন, তখন এই বাংলাই পদার্থবিজ্ঞানের পৃথিবীর কেন্দ্র হইয়াছিল। অর্থাৎ, পূর্বনির্ধারিত বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুটি কেন্দ্র নহে, বৌদ্ধিক ঔজ্জ্বল্যে যে বিন্দুটি দীপ্ততম, তাহাকে কেন্দ্র করিয়াই বৃত্ত রচিত হয়। তাহাই প্রকৃত কেন্দ্র।
প্রশ্ন হইল, কলিকাতা কি এই অর্থে কেন্দ্র হইয়া উঠিতে পারে? উত্তর অনিশ্চিত। এই শহর, এই রাজ্য যে বৌদ্ধিক অবনমনের পথে হাঁটিয়াছে, তাহাতে এই উত্তরণ অতি কঠিন একটি কাজ। এক সময় প্রকৃতার্থে বুদ্ধিজীবীদের শহর হিসাবে কলিকাতার খ্যাতি ছিল, এই শহরের মেধার দ্যুতি স্বভাবতই বিশ্ববাসীর চোখে পড়িত। কিন্তু, সেই দিন গিয়াছে। অতীত গৌরব রোমন্থন করিয়া বাঙালি দিন কাটাইতে পারে বটে, বিশ্বজন ফিরিয়া তাকাইবে না। কলিকাতাকে যদি বৌদ্ধিক দুনিয়ার কেন্দ্রে আসিতে হয়, তবে কঠিন চেষ্টা করিতে হইবে। মধ্যমেধার সাধনা ত্যাগ করিয়া উৎকর্ষের পূজারি হইতে হইবে। মেধার মধ্যে রাজনৈতিক রঙ, ‘আমরা-ওরা’ খুঁজিলে চলিবে না। এই বঙ্গভূমি ব্যতীত বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তেই বাঙালি সফল। সেই সাফল্যের মন্ত্রটি শিখিতে হইবে। কিন্তু সর্বাগ্রে বিশ্বাস করিতে হইবে, বাংলার পক্ষে সত্যই কেন্দ্রে অবস্থান করা সম্ভব। |