মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়কে উৎকর্ষের কেন্দ্র করিতে মনস্থ করিবার পর হইতেই একটি বিতর্ক সৃষ্টি হইয়াছে। তাহা হইল, কোনও একটি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ রূপে চিহ্নিত করিয়া তাহার উৎকর্ষ সাধনই কি সরকারের কর্তব্য? না কি অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলির উন্নতির জন্য সরকারকে সমান ভাবে তৎপর হইতে হইবে? অর্থ সাহায্য এবং অপরাপর সুযোগ-সুবিধা কি একটি প্রতিষ্ঠানেই কেন্দ্রীভূত করা উচিত, নাকি সকল প্রতিষ্ঠানে সেই সকল সমান ভাগ করিয়া দিতে হইবে? এই বিতর্ক নানা সময়ে নানা ভাবে সামনে আসিয়াছে। সম্প্রতি অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী ‘মেন্টর গ্রুপ’ হইতে ইস্তফা দিবার জন্য সরকারের বৈষম্যের প্রশ্নটি পুনরায় উত্থাপিত হইয়াছে। সুকান্তবাবুই তাহা তুলিয়াছেন। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫টি ‘হেরিটেজ চেয়ার’ পদে অধ্যাপক নিযুক্ত করিবার খরচ রাজ্য সরকারই দিবে, এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করিয়া তিনি ১০ সদস্যের দল হইতে ইস্তফা দিয়াছেন। তাঁহার বক্তব্য, উত্তম শিক্ষকের প্রয়োজন সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই রহিয়াছে। তাহাদের উৎকর্ষ বাড়াইবার ব্যবস্থা না করিয়া কেবল প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়েই সকল সরকারি অনুগ্রহ বর্ষিত হওয়া যুক্তিযুক্ত নহে। অনেকে হয়তো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতি বৈষম্যের সহিত সামাজিক বৈষম্যের অভিযোগও তুলিবেন। পঠন-পাঠনে প্রেসিডেন্সি কলেজের ঐতিহ্য রহিয়াছে ঠিকই, কিন্তু সেই ঐতিহ্য প্রধানত সমাজের উচ্চশ্রেণিতেই কেন্দ্রীভূত। প্রেসিডেন্সি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত উচ্চমেধাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত এ রাজ্যের সম্পন্নতম পরিবারগুলিরই সন্তান। সরকারি আনুকূল্যের প্রথম দাবিদার কি ইহাদেরই হইবার কথা? নাকি অসমাপ্ত পরিকাঠামো, সামান্য সুযোগ-সুবিধায় চলিতেছে যে সকল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, যাহাদের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী স্বল্পবিত্ত পরিবারের সন্তান, তাহাদের আবশ্যক প্রয়োজনগুলি মিটাইতে সরকারি সম্পদ ব্যয় করাই সঙ্গত? যেখানে প্রয়োজন বেশি, সেখানে সরকারি সম্পদ অধিক বরাদ্দ করাই কি সামাজিক ন্যায় নহে?
এই প্রশ্ন অযৌক্তিক নহে। ইহার মূলে যে সমাজচিন্তা রহিয়াছে তাহাও গ্রাহ্য। কিন্তু সরকারের কর্তব্য কী, তাহার একমাত্রিক বিচার করিতে গেলে ভুল হইতে পারে। শিক্ষার স্তরের প্রভেদ অনুসারে সরকারের কর্তব্যেরও পরিবর্তন হয়। বুনিয়াদী শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘সর্বশিক্ষা’ সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য হইতে হবে, সন্দেহ নাই। তাই দারিদ্র কিংবা অন্যান্য সামাজিক সমস্যা যাহাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ করিবার অন্তরায় হইয়া দাঁড়াইতে পারে, তাহাদের জন্য সরকারকে অধিক সম্পদ এবং সুযোগ-সুবিধা ব্যয় করিতে হইবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কিন্তু চিত্রটি ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার বিস্তারই প্রধান লক্ষ্য নহে, শিক্ষার উৎকর্ষ প্রধান লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন। প্রতিযোগিতা ভিন্ন উৎকর্ষ সম্ভব নহে, তাই অন্যান্য রাজ্যের সহিত প্রতিযোগিতা করিয়া যাহাতে এ রাজ্যের সেরা ছাত্ররা জিতিয়া যাইতে পারে, তাহার উদ্যোগ লইতে হইবে সরকারকে। কিন্তু তাহার শর্ত ভিন্ন। সকলকে সমান সম্পদ বণ্টনের মাধ্যমে উৎকর্ষের সৃষ্টি করা সম্ভব নহে। তাহার জন্য উৎকৃষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অন্যদের চাইতে অধিক সুবিধাই দিতে হইবে। সকলের প্রতি সমান মনোভাবাপন্ন হইলে কোনও প্রতিষ্ঠানই উৎকর্ষে শর্ত পূরণ করিতে পারিবে না। সেই দৃষ্টিতে বিশেষ ভাবে একটি প্রতিষ্ঠানে সকল সম্পদ, সুযোগ-সুবিধাকে কেন্দ্রীভূত করিবার সিদ্ধান্ত হয়তো ভ্রান্ত নহে। তাহা সংকীর্ণ দৃষ্টির পরিচয় বলিয়া গ্রহণ না করিয়া, বাস্তব বোধের পরিচয় বলিয়া অনেকেই গ্রহণ করিবেন। ইহাতে অন্যায় কী, অন্যায় কোথায়, তাহা লইয়া আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে। |