মাওবাদীদের সামলাতে গিয়ে মনমোহন সিংহ সরকারের অন্দরেই ‘গৃহযুদ্ধ’ বেঁধেছে। মাওবাদী অধ্যুষিত জেলাগুলির উন্নয়ন নিয়ে সম্মুখ সমরে নেমেছে যোজনা কমিশন, কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া বা বাঁকুড়ার মতো জেলাগুলিতে উন্নয়নের অভাবেই মাওবাদীরা ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। দেশের এমন ৮২টি জেলার জন্য একত্রিত কার্য যোজনা (আইএপি)-র আওতায় বিশেষ অর্থ বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্র। এ বছর জেলা পিছু ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র। গত বছর বরাদ্দ হয়েছিল ২৫ কোটি টাকা। কোথায়, কোন প্রকল্পে এই অর্থ খরচ হবে, তা ঠিক করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলাশাসক, পুলিশ সুপার ও বন দফতরের জেলা আধিকারিককে। স্থানীয় পঞ্চায়েত ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এই প্রক্রিয়ায় সামিল করা হয়নি। উন্নয়নের অর্থ সরাসরি জেলা প্রশাসনের হাতে চলে যাওয়ায় যথেষ্ট সাফল্য মিলেছে বলেও এত দিন কেন্দ্রের তরফে দাবি করা হয়েছে।
কিন্তু, এখন এই ‘সাফল্য’ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে যোজনা কমিশন। তাদের বক্তব্য, শুধু জেলা প্রশাসনের তিন আমলার হাতে অর্থ বরাদ্দের অধিকার দিয়ে দেওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই কোনও লাভ হচ্ছে না। কারণ পঞ্চায়েত বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মত না নেওয়ায় বহু ক্ষেত্রেই সঠিক জায়গায় টাকা খরচ হচ্ছে না। যোজনা কমিশন চাইছে, আগামী অর্থবর্ষ থেকে আইএপি প্রকল্প তুলে দেওয়া হোক। অন্য অনগ্রসর জেলাগুলির জন্য অনগ্রসর এলাকা অনুদান তহবিল (বিআরজিএফ) থেকে বরাদ্দ করা হয়। এই বরাদ্দের ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের ভূমিকা আছে। ওই তহবিল থেকেই মাওবাদী অধ্যুষিত জেলাগুলির জন্যও বরাদ্দ করা উচিত বলে মনে করেন যোজনা কমিশনের কর্তারা।
এই একই যুক্তি দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ। এ বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও লিখেছেন। তাঁর মতে, সব ক’টি জেলাকে একই সারিতে ফেলে
দেওয়াটাও ভুল। কারণ সব জেলার সব ব্লকের পরিস্থিতি একরকম নয়। প্রথমে ৩৫টি জেলা থেকে শুরু করে এখন আইএপি-র আওতায় ৮২টি জেলাকে নিয়ে আসা হয়েছে। রমেশের বক্তব্য, তার বদলে সব চেয়ে অনগ্রসর জেলা ও পিছিয়ে পড়া ব্লকগুলির দিকে নজর দেওয়া উচিত। গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েত মন্ত্রককে পাশে পাওয়ায় খুব শীঘ্রই এ বিষয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে নোট বিলি করতে চাইছে যোজনা কমিশন।
পাল্টা যুক্তি সাজিয়ে তৈরি হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও। মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, সবচেয়ে অনগ্রসর জেলাগুলি এখনও মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে প্রশাসনের কোনও অস্তিত্ব নেই। যে সব জেলায় মাওবাদীদের হুমকি বন্ধ করে প্রশাসনের কাজ শুরু হয়েছে, সেখানেই উন্নয়নের কাজ সম্ভব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য, সব জায়গায় পঞ্চায়েতকে সঙ্গে নেওয়াও সম্ভব নয়। কারণ বহু জায়গায় মাওবাদীদের দাপটে পঞ্চায়েতের অস্তিত্বই নেই। থাকলেও তা মাওবাদীরাই নিয়ন্ত্রণ করছে। আইএপি-র প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উন্নয়নের অভাব নিয়ে মাওবাদীদের প্রচারের জবাব দেওয়া। সাধারণ মানুষের চোখের সামনে দ্রুত কিছু উন্নয়নমূলক কাজ তুলে ধরা। সে জন্যই সরাসরি জেলা প্রশাসনের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ঠিক এই কারণে এ ক্ষেত্রে দুর্নীতিও কম হয়েছে।
এত দিন যোজনা কমিশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আইএপি প্রকল্পে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছিল। এ বার দুই শিবিরই বিবাদ মেটাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দরবার করতে চলেছে। কী বলছেন পশ্চিমবঙ্গের আমলারা? রাজ্য প্রশাসন সূত্রের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জেলায়, বিশেষ করে পশ্চিম মেদিনীপুরে এই প্রকল্পে যথেষ্ট সাফল্য মিলেছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর, শালবনির মতো বিভিন্ন জেলায় ছাত্রাবাস, শস্য গোলা, সেচ প্রকল্পের কাজ হয়েছে। যোজনা কমিশন এ বিষয়ে রাজ্যর প্রশংসাও করেছে। তবে এ বিষয়ে কেন্দ্রই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। |