প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে সামনে রেখে কয়লা-কেলেঙ্কারির অভিযোগ মোকাবিলায় নেমে পড়ল কংগ্রেস। বিজেপি সাংসদদের বাধার মধ্যেই আজ সংসদে বিবৃতি পেশ করলেন মনমোহন। এবং রীতিমতো আগ্রাসী ভঙ্গিতে জানিয়ে দিলেন, ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত যাবতীয় কয়লা ব্লক বণ্টনের দায় তিনি নিচ্ছেন। কিন্তু ব্লক বণ্টনের ফলে সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতি নিয়ে কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (ক্যাগ) যে রিপোর্ট দিয়েছে, তা ‘ত্রুটিপূর্ণ’ এবং ‘বিতর্কিত’। ফলে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে।
লোকসভা ভোটের দেড় বছর আগে খোদ মনমোহন সিংহের সৎ ভাবমূর্তিতে আঁচড় কাটতে উঠে পড়ে লেগেছে বিজেপি। কয়লার ব্লক বণ্টন নিয়ে ক্যাগের রিপোর্টকে হাতিয়ার করে প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি করেছে তারা। যার জেরে গত কয়েক দিন ধরেই অচল সংসদের বাদল অধিবেশন।
এই অবস্থায় মনমোহনকেই সামনে এগিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কৌশল নিল কংগ্রেস। এ ক’দিন চুপ থাকার পরে ইরান সফরে যাওয়ার আগের দিন কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে বিজেপি-কে পাল্টা আক্রমণ করে প্রধানমন্ত্রী বললেন, “হাজারো জবাবো সে আচ্ছি হ্যায় মেরি খামোসি, না জানে কিতনে সওয়ালো কা আব্রু রাখে।” (হাজার জবাবের চেয়ে আমার নীরবতা ভাল। তাতে অনেক প্রশ্নেরই সম্মান রক্ষা হয়।) কংগ্রেস সূত্র বলছে, নিলাম না করে কয়লা ব্লক বণ্টনের রেওয়াজ সেই ১৯৯৩ সাল থেকে চলে আসছে। এমনকী এনডিএ আমলেও এ জিনিস হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ইউপিএ জমানায় কয়লা ব্লক নিলামের ব্যাপারে যে সব রাজ্য আপত্তি জানিয়েছিল, তাদের মধ্যে বাম-বিজেপি শাসিত রাজ্যও ছিল।
|
সংসদের সামনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি প্রধানমন্ত্রী। সোমবার। ছবি: পি টি আই |
কংগ্রেসের এই আগ্রাসী রণনীতির মুখে বিজেপি-ও অবশ্য হাত গুটিয়ে বসে নেই। সংসদ অচল করে দেওয়ার পাশাপাশি আজ আরও চাঁচাছোলা ভাষায় কংগ্রেস তথা প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করেন বিজেপি নেতৃত্ব। এমনকী সাংবাদিক বৈঠক করে লোকসভার বিরোধী দলনেত্রী
সুষমা স্বরাজ এ-ও বলেন, “কয়লা ব্লক বণ্টন করে মোটা ‘মাল’ নিয়েছে কংগ্রেস।”
বিজেপি-র সেই আক্রমণের মোকাবিলায় সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অম্বিকা সোনি সাংবাদিক বৈঠক করেন। কাল কংগ্রেস সংসদীয় দলের বৈঠক থেকে দলনেত্রী সনিয়া গাঁধী ফের আক্রমণ শানাবেন বলে খবর। কংগ্রেসের পক্ষে আশার খবর হল, এই যুদ্ধে বিজেপি এক প্রকার নিঃসঙ্গ। সংসদ অচল করে রাখার ব্যাপারে চার বাম দল, বিজু জনতা দল, তেলুগু দেশম, এডিএমকে এমনকি এনডিএ শরিকদেরও আপত্তি রয়েছে। অন্য দিকে, ইউপিএ কিন্তু ঐক্যবদ্ধ।
কয়লা ব্লক বণ্টন নিয়ে আজ তাঁর চার পাতার বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বিজেপি-র পাশাপাশি ক্যাগেরও মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, ১৪২টি কয়লা খনি বণ্টনের ফলে সম্ভাব্য ১ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে ক্যাগ মন্তব্য করলেও তাদের গণনা পদ্ধতি বিতর্কিত এবং তাতে অনেক প্রক্রিয়াগত ভ্রান্তি রয়েছে।
প্রথমত, এক-একটি কয়লা ব্লক থেকে এক-এক পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। কিন্তু ক্যাগ সেই পার্থক্য হিসেবের মধ্যে ধরেনি।
দ্বিতীয়ত, এক-একটি ব্লকের কয়লার মান এক-এক রকম। কিন্তু মূল্য নির্ধারণের সময় কোনও বিভেদ করেনি ক্যাগ।
তৃতীয়ত, কয়লা ব্লকগুলি সুনির্দিষ্ট কারণে বেসরকারি সংস্থাকে দেওয়া হয়েছিল। সেই কয়লা তারা কোনও ভাবেই বাজারে বিক্রি করতে পারবে না।
চতুর্থত, কয়লা খনি নিলাম করে মুনাফা করার কোনও লক্ষ্য সরকারের ছিল না। কারণ, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা নিলাম করা হলে বিদ্যুতের মাসুল বেড়ে যাবে।
পঞ্চমত, বেসরকারি সংস্থাগুলিকে কয়লা ব্লক বণ্টন করার সময় বলে দেওয়া হয়েছিল যে, তারা তাদের মুনাফার ২৬ শতাংশ স্থানীয় এলাকার উন্নয়নে খরচ করবে। কিন্তু গণনার সময় এ সব একেবারেই বিবেচনা করেনি ক্যাগ।
প্রধানমন্ত্রী ক্যাগের হিসাবকে বিতর্কিত বলে থেমে গেলেও কংগ্রেস আরও এক ধাপ এগিয়ে আজ এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করেছে। দলের মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারি বলেন, “ক্যাগ তার এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে কাজ করেছে। সরকারের কোনও আর্থিক প্রক্রিয়ায় অনিয়ম হয়েছে কিনা, সেটা লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব ক্যাগের। কিন্তু সরকার কোন নীতি গ্রহণ করবে, তা ক্যাগ বলে দিতে পারে না।”
আর বিজেপি নেতা অরুণ জেটলির বক্তব্য, “প্রধানমন্ত্রী নিজের উপর দায় নিয়েও কৌশলে তা এড়িয়ে যেতে চাইছেন। তাই কখনও ক্যাগের উপর দোষ চাপাচ্ছেন, কখনও রাজ্যের উপর।”
এই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট কয়লা নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি আপাতত চলবে। |