মুখ্যমন্ত্রীর সভায় ঢুকে প্রশ্ন করতে গিয়ে বিশৃঙ্খলা বাধানোর দায়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন বিনপুরের শিলাদিত্য চৌধুরী। সেই একই মুখ্যমন্ত্রীর সমাবেশে গিয়ে প্রচারপত্র ছড়িয়ে নিজেদের দুর্দশার ‘বিচার’ চেয়েছিলেন কলকাতার কিছু কর্মচ্যুত তরুণ! তাঁদের অভিযোগের তদন্তের নির্দেশ হয়েছে রাতারাতি।
বেলপাহাড়িতে ‘হাতেনাতে’ গ্রেফতার হয়েছিল। কলকাতায় হাতেনাতে তদন্তের নির্দেশ হয়েছে!
শ্রম দফতরের প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রকল্পের জন্য শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করাতে পারলে সামান্য পারিশ্রমিক মিলবে, এই শর্তে ২০০৩ সালে নিয়োগ করা হয়েছিল লেজার কিপার নামে এক শ্রেণির কর্মচারীকে। কথা ছিল, অবসরপ্রাপ্তদেরই এই কাজে নিয়োগ করা হবে।
কিন্তু খাস কলকাতায় লেজার কিপার হিসাবে কাজে লাগানো হয়েছিল তরুণদের। তাঁদের অভিযোগ, নিয়োগ বা মজুরির কোনও কাগজপত্রও কস্মিন কালে রাখা হয়নি! রাজ্যে পালাবদলের পরে গত এক বছরেরও বেশি
সময় এঁদের পারিশ্রমিক বন্ধ। কাজ নেই। এমনকী, দফতরে ঢুকতেও মানা করে দেওয়া হয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ।
জীবিকার সঙ্কটে পড়ে লেজার কিপাররা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছিলেন। তাঁদের অভিযোগ পুরোটাই বিগত বাম জমানার বেনিয়মের বিরুদ্ধে। মরিয়া হয়ে ‘বিচার’ চাইতে গত মাসে তাঁরা রীতিমতো প্রচারপত্র ছাপিয়ে ঢুকে পড়েন নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে শ্রম দফতরেরই একটি অনুষ্ঠানে, যেখানে মুখ্য চরিত্র ছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। এমন মরিয়া আবেদনের প্রাথমিক ফল অবশ্য তাঁরা পেয়েছেন। রাজ্যের শ্রমসচিব লিখিত নির্দেশ দিয়ে শ্রম কমিশনারকে লেজার কিপারদের বিষয়টি নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে তদন্তের পরেও তাঁদের জীবিকার সুরাহা হবে, এমন কোনও আশ্বাস অবশ্য এখনও নেই।
দফতরে ঢোকা বন্ধ হলেও লেজার কিপাররা তাঁদের আবেদনপত্রে কলকাতায় ৬ নম্বর চার্চ লেনে শ্রম দফতরের ঠিকানাই ব্যবহার করেছেন। কলকাতায় যে ১১ জন এক বছরেরও বেশি বেকার হয়ে আছেন, ন্যূনতম মজুরি না-দিয়েই দিনের পর দিন কাজ করানো হত বলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁদের অভিযোগ। তাঁদের মাত্র এক টাকার বিনিময়ে ৯টি কাজ করতে হত, বসতে হত রাস্তায় শ্রম দফতরের শিবিরেও। ‘মিথ্যা প্রলোভন’ দেখিয়ে বাম জমানায় বহু দিন কাজ করানোর পরে এখন তাঁদের বিনা পারিশ্রমিকে বসে থাকতে হচ্ছে। এই অভিযোগ হাতে আসার পরেই তদন্ত করে দ্রুত রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন শ্রমসচিব। শ্রম দফতর সূত্রের খবর, রিপোর্টও ইতিমধ্যে তৈরি।
শ্রমসচিব পি রমেশ কুমার বলেছেন, “সাময়িক ভাবে কাজ করানোর জন্য অবসরপ্রাপ্ত
ব্যক্তিদের নেওয়া হত। অনেকেরই বেশ কিছু টাকা বকেয়া আছে। অভিযোগ পেয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি।” তবে শ্রম সচিব জানাচ্ছেন, হাতে-কলমে নাম নথিভুক্তির এই ব্যবস্থা যে বেশি দিন চলবে না, তা-ও আগেই বলে দেওয়ার কথা ছিল। রমেশ কুমারের কথায়, “কম্পিউটারের ব্যবস্থা চালু হয়ে গেলে এঁদের দিয়ে কাজ করানোর আর দরকার থাকত না। সেই জন্যই অবসরপ্রাপ্তদের নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তবু যাঁদের অভিযোগ বৈধ, তাঁদের সুরাহার ব্যবস্থা করার চেষ্টা হচ্ছে তদন্তের মাধ্যমে।”
শ্রম দফতর সূত্র অবশ্য বলছে, অন্যত্র নির্দেশিকা মেনে অবসরপ্রাপ্তদের নিয়োগ করা হলেও কলকাতায় লেজার কিপার হিসাবে তরুণদের কাজে লাগানো হয়েছিল। সরকারি আধিকারিকদেরই একাংশ চাইছেন, এমন বেনিয়মের ঘটনায় ‘দোষী’ অফিসারদের শাস্তি হোক। তদন্তের নির্দেশের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন করা হলে ডেপুটি শ্রম কমিশনার রজত পাল অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন।
রাজ্যের প্রাক্তন শ্রমমন্ত্রী এবং সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য অনাদি সাহুর বক্তব্য, “আমি মন্ত্রী হওয়ার আগেই এই ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। নাম লেখানোর জন্য ওঁরা প্রায় এক টাকা করে পেতেন বলে জানতাম। তবে আমার সময়ে কেউ এই নিয়ে কোনও অভিযোগ জানাতে আসেননি।”
সরকারি সূত্রের ব্যাখ্যায়, পদ্ধতিতে বেনিয়ম রেখে লেজার কিপারদের সমস্যায় ফেলে গিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। আবার বাম জমানার নিয়োগ বলে তাঁদের প্রতি ‘সহানুভূতি’ দেখায়নি ‘পরিবর্তনে’র সরকার। সব দিক থেকেই তাঁরা হয়েছেন কোণঠাসা। আপাতত ‘হাতে-নাতে’ তদন্তের নির্দেশই তাঁদের ঈষৎ স্বস্তি! |