‘সবাই চায়’, আসল ফেলে দিব্যি বিকোচ্ছে প্রতিলিপি
“দাদা, হারানের নাতজামাইটা কত?”
নির্লিপ্ত মুখে জবাব এল, “দেড় টাকা।”
বাইরে দাঁড়ানো ক্রেতা শশব্যস্ত, “দিন না একটা!”
চোখের নিমেষে হাতে চলে এল ‘হারানের নাতজামাই’!
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসের (আশুতোষ শিক্ষা প্রাঙ্গণ) ভিতরে একটি দোকানে দোকানি আর ক্রেতার কথোপকথন।
কিন্তু ‘হারানের নাতজামাই’ তো...
হ্যাঁ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ছোট গল্পই বটে! তবে অবাক হওয়ার জায়গা বিশেষ নেই। ওই ক্যাম্পাসে যাঁদের যাতায়াত রয়েছে, তাঁরা সকলেই জানেন, এমনই হয়!
শুধু এই বিশেষ গল্পটি নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্গত যে ক’টি ছোটগল্প, তার সবক’টিই হাতে গরম মেলে ওই দোকানে। প্রতিলিপি হয়ে! বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের কাছে ওটা কার্যত ‘লাইফলাইন’। কেন? যে বইয়ে গল্পটি রয়েছে, তার সবটা হয়তো প্রয়োজন নেই পড়ুয়াদের। কিন্তু ওই একটি গল্প তো সিলেবাসে রয়েছে। অর্থাৎ ওটা পেতে গেলে হাতে চাই পুরো বইটা। এখানেই পরিত্রাতা হয়ে হাজির বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ওই দোকানটি। পড়ুয়াদের ‘সুবিধার্থে’ বই থেকে শুধু ওই গল্পটির প্রতিলিপি করে নিয়ে বিক্রি করে তারা।
শিয়ালদহের দোকানে প্রতিলিপি করতে ব্যস্ত এক কর্মী। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
দিল্লির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরেই একটি দোকানে এ রকমই যথেচ্ছ প্রতিলিপি হচ্ছে বলে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে তিন নামী প্রকাশক সংস্থা। তাদের দাবি, এ কাজ বেআইনি। এই সূত্র ধরেই প্রশ্ন ওঠে এ রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছবিটা ঠিক কেমন? বিশেষত বর্তমান অবস্থায় সব স্তরের পড়ুয়াদের মধ্যেই প্রতিলিপির জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। বাস্তব চিত্র বলছে, শুধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাস নয়, আসল বই থেকে প্রয়োজনীয় অংশটুকুর প্রতিলিপি করে রাখার এই রেওয়াজ রয়েছে প্রায় সর্বত্রই।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসের (বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ) কথাই ধরা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভবনের একেবারে উপর তলায় ক্যান্টিনের পাশেই ছোট্ট দোকান। প্রায় সর্বক্ষণই উপছে পড়া ভিড়। সব বিভাগের পড়ুয়াদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে সবরকমের ‘বই’ সরবরাহ করে চলেছে দোকানটি। না, আসল নয়। পুরো বইটার প্রতিলিপি! এবং সেটা একেবারে বইয়ের আদলেই বাঁধাই করা। ‘হটকেক’-এর মতো তা বিকোচ্ছে নিমেষে। কেন তা বুঝতে আসল আর প্রতিলিপি করা বইয়ের দামের পার্থক্যটায় এক বার চোখ রাখা যাক। স্নাতকোত্তর স্তরের পড়ুয়াদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি ‘সেল বায়োলজি’র বইয়ের বাজারে দাম দুই থেকে তিন হাজার টাকা। প্রচ্ছদ সমেত প্রায় পনেরোশো পাতার সেই বই প্রতিলিপি হয়ে বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের দোকানটিতে মেলে সাড়ে ছ’শো থেকে সাতশো টাকায়! বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকেই কোনও এক পড়ুয়া নিজের কার্ডে আসল বইটি সংগ্রহ করে দিয়ে আসেন ওই দোকানে। ব্যস, তার পর তো একটা দিনের ব্যাপার সেটা থেকে হুবহু আর একটা ‘বই’ তৈরি করে ফেলা! বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের ওই দোকানটির ‘খ্যাতি’ এতটাই যে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও পড়ুয়ারা এসে প্রয়োজনীয় বই সংগ্রহ করে নিয়ে যান সেখান থেকে! কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া এবং বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আশপাশে এমন ‘ছাত্রদরদী’ দোকানের হদিশ থাকে শুধু পড়ুয়াদের কাছেই। প্রকাশকদের নজর এড়িয়ে জাঁকিয়ে ব্যবসা করে চলেছে তারা।
কপিরাইট আইন বলে, গোটা বিষয়টাই বেআইনি। এ ব্যাপারে প্রকাশক এবং লেখকদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার দায়িত্বে রয়েছে একটি সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান রেট্রোগ্রাফিক রাইটস অর্গানাইজেশন’ (আইআরআরও)। তাদের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, কপিরাইট আছে এমন যে কোনও বই থেকে প্রতিলিপি করতে গেলে প্রত্যেককেই অনুমতি নিতে হবে। যাকে পরিভাষায় বলে ‘রেট্রোগ্রাফিক ইউসেজ লাইসেন্স’। কিন্তু প্রতিলিপির এই বাড়বাড়ন্তর যুগে তেমনটা করা তো বাস্তবসম্মত কারণেই সম্ভব না বলে অনেকেই মনে করেন। এ প্রসঙ্গে কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারের অধিকর্তা স্বপন চক্রবর্তী বলেন, “বইয়ের থেকে প্রতিলিপি করার ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বে একটা ব্যাপার চালু আছে, যেটাকে বলে ফেয়ার ইউজ। অর্থাৎ বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য প্রতিলিপি করার ক্ষেত্রে অনুমতি লাগলেও ছাত্র ও গবেষকদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য তা প্রয়োজন নেই।” আর আইআরআরও প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “বিশদে জানি না। তবে ওরা যদি অনুমতি নিতে হবে বলে দাবি করে, তা হলে ব্যাপারটা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।”
পড়ুয়া আর ব্যবসায়ীরা কিন্তু এত তত্ত্বকথার ধারেকাছেও নেই। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজেরই এক পড়ুয়ার কথায়, “আসল বই অত দাম দিয়ে কেনা সম্ভব নয়। আরও সমস্যা, লাইব্রেরিতেও দামি বইগুলো একটার বেশি সাধারণত থাকে না। এ ভাবে যদি সেটা হাতে আসে তা হলে কেন কিনব না?”
বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করা গেল, “এটা বেআইনি জানেন?” তাঁর বিব্রত জবাব, “জানি তো। কিন্তু এ ভাবেই তো সবাই চায়।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.