‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’ উত্তরের মহাকাব্য কিনা তর্ক উঠলেও তিস্তা যে উত্তরের গঙ্গা, উত্তরবাংলার প্রাণ, তা নিয়ে তর্ক নেই। ঋগ্বেদে উল্লিখিত “সদানীর” নদীটি কালিকা পুরাণমতে পার্বতীর স্তনধারা থেকে উৎপন্ন। তেমনই হিমলয়ের অববাহিকায় সিকিমের চোমলহরি থেকে উৎস তিস্তার বাঁ দিকে পাঁচটি উপনদী লাচেন ছু, তালুং ছু, রঙ্গীত, কালীঝোরা এবং সবার উপরে শোনজ ছু। আবার এ নদীর ডান দিকেও তেমনই পাঁচটি উপনদীছালামো লেখাছু, দিকছু, রংপো ছু, রিলিওরিয়াং। আর শিলিগুড়ির অদূরে সেবক থেকে সমতলে সেই মাতৃস্তন সমৃদ্ধ করল সমগ্র জনপদ। আর এ ভাবেই উত্তরবঙ্গবাসীকে জলরাশির আঁচলে আগলে রেখেছেন মাতৃসমা তিস্তা। ঈশ্বরের পক্ষে সর্বত্র গমন অসম্ভব। তাই তিনি পাঠালেন জননী জনকল্যাণে। একটাই নদী বহুরূপা, বহু নাম তবু এ নদীর কোনও ডাকনাম নেই, শুধু তিস্তা! আর এই তিস্তারই ত্রিস্রোতে কখনও সে মহাদেবের মতো সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংসের ত্রিশক্তির আঁধার। তাঁর জলে শস্যের ঘুম ভাঙে, নবান্নের ধান গোলা ভরে, আবার জননী তিস্তার রুদ্ররূপই রাতের ঘুম কেড়ে নেয় উত্তরবাসীরলেখা আছে ৬৮-র ফলক। এ ভাবেই ভয়ঙ্করী তিস্তা এক সময় শান্ত হল পুজো পেয়ে, অলৌকিক নয় চোখে দেখা‘তিস্তা বুড়ির গান’ গেয়ে অসাধ্যসাধন হল। সন্তানের গানে শান্ত হয়ে ঘুমে গেলেন উত্তরজননী। স্বপ্ন দেখলেন, দেখালেন জনপদে। যুগে যুগে তিস্তার গতিপথের বিবর্তনের বিস্তৃত তথ্যাদি প্রদান করেছেন ড. চারুচন্দ্র সান্যাল। তিনি বুকানন হ্যামিলটন (১৮৫৯), ফারমিনজার (১৭৭০-৭৯), উইলিয়াম হান্টার (১৮৭৬) এর বিবরণ এবং বোল্টের ম্যাপ (১৭৭২) ও রেনেলের মানচিত্র (১৭৭৯-৮৯) এর মাধ্যমে তিস্তার গতিপথের খামখেয়ালিপনাকে ব্যাখ্যা করেছেন। এ ক্ষেত্রে ‘তিস্তাবুড়ি’ ধারণাটির একটি চিত্র স্যার জোসেফ ডালটন হুকারের বর্ণনায় পাওয়া যায়। তার বঙ্গানুবাদ করলেনদীর উৎপত্তিস্থলে ও পরবর্তী ৪ মাইল ভাটি পর্যন্ত জলস্রোতে মানুষের মাথার আকৃতির মতো কিছু কিছু বোল্ডার দেখা যায়। নৌকার মাঝিরা এমন এক সুবিশাল পাথরের চাঁইয়ের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল যা একটা মানুষের শরীরের মতো ও সুবিশাল। যে নদীগর্ভে মানবাকৃতি প্রস্তরখণ্ডের ধড় ও শিরের উজ্জ্বল উপস্থিতি, সে নদীকে ‘তিস্তা বুড়ি’ ভেবে নিতে মানুষের দ্বিধা করে না। সমতলের কাসিয়াবাড়ি থেকে ঘোড়ামারা হয়ে চিলাহাটি পর্যন্ত তিস্তা স্থির, স্থিতধী, শান্ত তেমনই সমতলের তিস্তা বড্ড নীরব। পর্বতে কিশোর, যৌবন পেরিয়ে সমতলে বার্ধক্যে উপনীত নদী। বিশিষ্ট গবেষক গিরিজাশংকর রায় লিখছেন “তিস্তার নামে যে নদী মাতৃকার কল্পনা করা হয়েছে তা বৃদ্ধকালের। তিস্তাপারের সুপ্রশস্ত চরে কাসিয়াফুলের মতো চুল, দু’পাড়ের সুবিশাল বালুচরের সাদা শাড়ি, কৃষ্ণচূড়া, শিরিষের লালচে ফুলের প্রণামীতিস্তাবুড়িপুজোর এটাই প্রাকৃতিক আয়োজন।” |
আরও একটা বর্ষা মরসুম আমরা পার করলাম। এবং খুব অবশ্যম্ভাবী ভাবেই অধিকাংশ বৃষ্টির জলই আমরা অপচয় করলাম। প্রশ্ন উঠবে কেন? এর আগেও তো বৃষ্টিপাতের কনসেপ্টটি এ ভাবেই ছিল। তখন তো কোনও হেলদোল দেখা যায়নি? কেউ তো উচ্চবাচ্য করেননি এ নিয়ে? তা হলে এখন কেন? এখন এই কারণেই, সাম্প্রতিক কালেই জলসঙ্কটের বিষয়টি খুব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তার ফলেই আবশ্যক হয়ে পড়েছে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের বিষয়টি। কারণ, কিছু দিন পরে থেকেই আগামী বর্ষার আগে পর্যন্ত আবার আমরা দেখব চাষের জল নেই। জলের অভাবে চাষের খেত ফেটে চৌচির। বর্ধিত জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাদ্যের জোগানের ক্ষেত্রে হাহাকারের চিত্রটি আবার এক বার সামনে আসবে। কিন্তু কী অবাক করা কথা যে, সেই সমস্যাগুলির মোকাবিলায় বৃষ্টির জলকে কাজে লাগান হচ্ছে না। অর্থাৎ যেটা বলতে চাইছি তা হল বৃষ্টির জল সংরক্ষণের বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা আমরা বুঝতে পারছি ঠিকই কিন্তু এখনও তা খাতায় কলমেই রয়ে গিয়েছে। এর প্রায়োগিক দিকটি বিশেষত সমগ্র উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রেই তা অনুপস্থিত। উত্তর দিনাজপুরের বাহিন কিংবা দক্ষিণ দিনাজপুরের তপন, বংশীহারি গঙ্গারামপুর কুমারগঞ্জের ক্ষেত্রে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ অপরিহার্য একটি দিক। তাকে অবহেলা করা হচ্ছে। প্রধানত দুই রকম পদ্ধতিতে বৃষ্টির জলকে ধরে রাখার ব্যবস্থা করা যায়। বৃষ্টি হওয়ার পর তা মাটিতে চুঁইয়ে মাটির ফোকরগুলি ভরে যাওয়াকে in-sita সংরক্ষণ বলে। এই চুঁইয়ে যাওয়া আবার নির্ভর করে মাটির উপরকার গ্রন্থন-এর উপর যা সাধারণত অপরিবর্তিত থাকে। আর একটি পদ্ধতি হল প্রবহমান বৃষ্টির জলধারা ছোট ছোট জলাধারে ধরে রাখা। এবং পরবর্তীতে এই সব জলাশয় থেকে জলসেচের ব্যবস্থা করা।
‘শ্রী’ পদ্ধতি (srisystem of rice inteusification) যা কিনা আমন কিংবা বোরো ধানের ক্ষেত্রে অল্প জলে চাষ করে অভাবনীয় ফসল ফলানো যায়সেই পদ্ধতিও জনপ্রিয় হল না এখনও। সে ক্ষেত্রেও বৃষ্টির জল সংরক্ষণের বিজ্ঞানকে অথবা সেই পরিকাঠামো তৈরিতে এখনও তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ছে না কেন? পরিবেশিক এই সঙ্কটের যুগে অজ্ঞতা তো এর ‘উত্তর’ হতে পারে না। তবে কি পরিবেশ বান্ধব প্রায়োগিক দিকটি এখনও আমাদের মজ্জায় এখনও তেমন করে ‘ঘা’ দিয়ে উঠতে পারেনি? তা যদি হয় তা হলে তো ভয়ঙ্কর!
ন্যাশনাল মনসুন মিশন মৌসুমি বৃষ্টিপাতের যাবতীয় সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর কথা বললেও তা যে এখনও ‘আঁতুর’ ঘরেই পড়ে রয়েছে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। আগামী বর্ষা মরসুমের আগেই এই নিয়ে যাবতীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলা অবশ্যই প্রয়োজন। ইজরায়েল কুয়াশার ফোঁটাকে কাজে লাগাচ্ছে। আর আমরা! |
দক্ষিণ দিনাজপুর জুড়ে বিষাক্ত পার্থেনিয়াম ছড়িয়ে পড়ছে। বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে পার্থেনিয়ামের দ্রুত বংশ বৃদ্ধি হচ্ছে। জেলা শহর বালুরঘাট-সহ আশপাশে সব অঞ্চল এবং বালুরঘাট-সহ আশেপাশের সমস্ত অঞ্চল এবং বালুরঘাট থেকে রায়গঞ্জ ও মালদা সড়কের দু’পাশ জুড়েই পার্থেনিয়ামে ছেয়ে গেছে। এমনকী কড রুটের রাস্তাগুলোতেও প্রচুর পার্থেনিয়াম। এ ছাড়া সরকারি বিভিন্ন বিল্ডিং, অফিস, কোয়ার্টারগুলোতেও পার্থেনিয়ামের বাড়বাড়ন্ত লক্ষ করা যাচ্ছে। |