অস্ট্রেলিয়ার মাঠে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে যুব বিশ্বকাপ জিতে উন্মুক্ত চন্দদের উসেইন বোল্টের কায়দায় উৎসব। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যে হায়দরাবাদে নিউজিল্যান্ডকে ইনিংসে হারিয়ে অবশেষে ০-৮ বিপর্যয়ের অভিশাপ থেকে মুক্তির পথে ধোনিরা।
দু’টো একই দিনে ঘটল। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে ঢুকে পড়ল এক বিরল সন্ধিক্ষণ।
২৫ জুন, ১৯৮৩-র লর্ডসে কপিলের দৈত্যদের প্রথম বিশ্বকাপ জয়। ২০১১-এর ২ এপ্রিল ওয়াংখেড়েতে ধোনিরা ফের ভুবনজয়ী। কিংবা ধরা যাক ২০০৭-এর ২৪ সেপ্টেম্বর ওয়ান্ডারার্সে ধোনির টিমের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়। বিশ্বজয়ের স্বাদ আর মোটেও নতুন নয় এ দেশের ক্রিকেটে। অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপেই তো এই নিয়ে তৃতীয় বার চ্যাম্পিয়ন হল ভারত। কিন্তু আর্কাইভ হাতড়ে এমন দিন খুঁজে পাওয়া মুশকিল যেখানে একই সঙ্গে সিনিয়র টিম বিদেশ সফরের কলঙ্কিত অধ্যায় থেকে সূর্যালোকে ফিরছে আর যুব দল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হচ্ছে।
গুরু গ্রেগের দেশে যুব দল ফেভারিট অস্ট্রেলিয়াকে হারাল ৬ উইকেটে। যেখানে স্বয়ং অধিনায়ক নেতৃত্ব দিল সামনে থেকে। বিশ্বকাপ ফাইনালে কোনও ভারত অধিনায়কের সেঞ্চুরি এই প্রথম। উন্মুক্ত চন্দের ১১১ নট আউট দেখার পর বলাবলি শুরু হয়ে গিয়েছে ‘ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন বিরাট কোহলি’। দু’জনেই দিল্লি ক্রিকেটের ফসল। চার বছর আগে অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপ জিতেই অধিনায়ক কোহলির উজ্জ্বল আবির্ভাব। এ দিন অনেকটা সে ভাবেই যেন ক্রিকেট আকাশে উদিত হল উন্মুক্ত চন্দ। চার বছর আগের যুব বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক এখন ভারতীয় ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত। এ দিন নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে উঠে যেটা বললেন সেটাও তো নতুন। “অস্ট্রেলিয়ার মাঠে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতা। এটা কখনও ঘটেনি। দুর্দান্ত জয়। অভিনন্দন!” |
দুর্দান্ত জয় হায়দরাবাদে উপ্পলের মাঠেও। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচও চার দিনে শেষ করে ফেললেন ভারতীয় স্পিনাররা। টাউন্সভিলের টনি আয়ার্ল্যান্ড স্টেডিয়ামের নায়ক যদি হয় উন্মুক্ত চন্দ, উপ্পলের নায়ক রবিচন্দ্রন অশ্বিন। কিন্তু কোথাও যেন আজ দাদাদের ছাপিয়ে ভাইদের দাপট। কোথাও যেন পঁচিশ-ছাব্বিশের তৃপ্তির হাসিকে ছাপিয়ে আঠেরোর বিজয়-হুঙ্কার! ধোনিদের ইনিংস ও ১১৫ রানে জয়টাই শুধু আজ ঘটলে কি সত্যিই এ রকম দেশ জুড়ে প্রভাব পড়ত? একে তো ঘরের মাঠে স্পিনের ছকে শত্রুকে বধ করার সেই চেনা ছক। তার ওপর শত্রুর নাম নিউজিল্যান্ড! টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে যারা আট নম্বরে। যাদের নীচে শুধু বাংলাদেশ!
দু’দিকের দুই উৎসবের ছবি পাশাপাশি রাখলেও একটা জায়গায় যেন যুবশক্তির গর্জনটাকেই বেশি জোরালো মনে হচ্ছে। যেটা টাউন্সভিলে ঘটল। যখন যুব দল কাপ নিয়ে অভাবনীয় ভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল উসেইন বোল্ট হয়ে! হায়দরাবাদ যেটা দেখল, সেটা মধ্যবয়স্কের পরিণত, সংযত প্রতিক্রিয়া। নাকি ভিতরে ভিতরে ধোনিরাও টের পাচ্ছিলেন, জিতলাম ঠিকই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মাঠে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতা ছোটরাই আজ চ্যাম্পিয়ন!
কয়েক ঘণ্টা আগেও ফেসবুক বা টুইটার খুললেই দেখা যাচ্ছিল ল্যান্স আর্মস্ট্রংকে নিয়ে প্রতিক্রিয়ার স্রোত। রাতারাতি অনেক বেশি আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এল অনূর্ধ্ব উনিশদের বিশ্বকাপ জয়। ‘উন্মুক্ত চন্দ ভারতীয় নায়কের নতুন মুখ। অভিনন্দন!’ টুইটার খুললেই পাওয়া যাচ্ছে। বক্তা কে? অমিতাভ বচ্চন! আরও আছে। যুবরাজ সিংহ যিনি এক দিন অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপ থেকেই প্রতিশ্রুতিমান হিসেবে উঠে এসেছিলেন, তিনি টুইট করেছেন, ‘অনূর্ধ্ব উনিশ টিমের পারফরম্যান্সে গর্বিত। ভারতীয় দলকে অভিনন্দন! দারুণ খেলেছ ক্যাপ্টেন উন্মুক্ত চন্দ।’ হরভজন সিংহ এখন কাউন্টি খেলছেন। প্রবাসে বসে তাঁর হয়তো ওয়াংখেড়েতে বিশ্বকাপ হাতে তোলার মুহূর্ত মনে পড়ে যাচ্ছিল। হায়দরাবাদে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ রবিচন্দ্রন অশ্বিন যে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নিয়ে চলে গেলেন, সে সবে ভাবিত না হয়ে ভাজ্জি বরং টুইট করেছেন, ‘চ্যাম্পিয়ন। চ্যাম্পিয়ন। চ্যাম্পিয়ন। ভারতীয় অনূর্ধ্ব উনিশ দল, তোমাদের অভিনন্দন আরও একটা বিশ্বকাপ দেশে আনার জন্য!’ এমনকী ক্রীড়ামন্ত্রী অজয় মাকেনও টুইটারে অভিনন্দন জানিয়েছেন উন্মুক্ত চন্দের দলকে।
অভিনন্দনের বন্যায় সত্যিই দাদাদের এ দিন পিছনে ফেলে দিয়েছে ভাইরা। পুরস্কারের স্রোতেও। ভারতীয় বোর্ড ঘোষণা করে দিয়েছে, অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপজয়ী দলের প্রত্যেক সদস্যকে ২০ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। শুধু তা-ই নয়, ধোনির টিমের দুরন্ত জয়ের দিনেই দাবি উঠে গিয়েছে, অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপ জয়ী এই ছেলেদের এখন থেকেই জাতীয় দলে সুযোগ দেওয়া হোক। ইয়ান চ্যাপেল যেমন বলেছেন, উন্মুক্ত চন্দের মতো প্রতিভাকে এখনই আন্তর্জাতিক মঞ্চে নামানো উচিত। অস্ট্রেলিয়ার যুব দল থেকে অতীতে ডেভিড বুন বা রিকি পন্টিংকে কম বয়সে তুলে আনার উদাহরণ টেনেছেন চ্যাপেল। ওয়াসিম আক্রমও তাই মনে করেন। কেকেআর বোলিং কোচ বলে দিয়েছেন, উন্মুক্ত চন্দের ইনিংস তাঁর দেখা অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপে খেলা সেরা ইনিংস।
উন্মুক্ত চন্দের কাপ জেতানো সেই সেঞ্চুরি।
রাহুল দ্রাবিড়-উত্তর যুগে চেতেশ্বর পূজারার নতুন ‘দেওয়াল’ হিসেবে আবির্ভাব।
রবিচন্দ্রন অশ্বিনের ম্যাচ থেকে ১২ উইকেট।
দেখতে গেলে টাউন্সভিল থেকে হায়দরাবাদ আজ তারুণ্যেরই দাপট সর্বত্র।
এক-এক সময় তাই খটকা লাগবে। ভিভিএস লক্ষ্মণের অবসর-বিতর্ক কি দিন সাতেক আগে সত্যিই ঘটেছিল? নাকি অনেক আগে থেকে ক্যামেরাবন্দি করে রাখা মুহূর্তগুলো স্রেফ প্রকাশ করা হয়েছিল গত ১৮ অগস্ট? জোড়া জয়ের ‘সন্ধিক্ষণে’ দাঁড়িয়ে সে দিনের ‘লক্ষ্মণরেখা’কে এক বার অন্তত মনে হতে পারে মধ্যগ্রীষ্মের বিভ্রম মাত্র! |