কলকাতা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর কার্তিক চট্টোপাধ্যায়ের ‘আত্মহত্যা’র জেরে ডিসি (সাউথ) দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহকে ছুটিতে চলে যেতে বলা হল। রবিবার থেকে তাঁকে এক মাস ছুটিতে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ কমিশনার আর কে পচনন্দা। এ দিকে কার্তিকবাবুর পরিবারকে যথোচিত সাহায্য জোগানোর ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্যোগী হয়েছেন বলে এ দিন জানিয়েছেন স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু।
কলকাতা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের পার্ক স্ট্রিট থানায় কর্মরত এসআই কার্তিকবাবুর দেহ উদ্ধার হয় শনিবার ভোরে, তাঁর বাগুইআটি-জ্যাংড়ার বিদ্যাসাগরপল্লির ফ্ল্যাটে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, তিনি গলায় দড়ি দিয়ে
|
কার্তিক চট্টোপাধ্যায় |
আত্মহত্যা করেছেন। বাগুইআটি থানার পুলিশ কার্তিকবাবুর দেহের কাছে একটি ‘সুইসাইড নোট’ পায়, যাতে তিনি তাঁর এই পরিণতির জন্য কলকাতা পুলিশের ডিসি (সাউথ) দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহকে দায়ী করে গিয়েছেন। পুলিশ-সূত্রের খবর: নোটে কার্তিকবাবু লিখেছেন, গত ৩ অগস্ট ডিসি তাঁকে নিজের চেম্বারে ডেকে অন্য দুই পুলিশকর্মীর সামনে অপমান করেন।
দেবেন্দ্রপ্রকাশ অবশ্য কার্তিকবাবুকে ‘অপমান’ করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। যদিও ঘটনাচক্রে তিনি ছুটিতে চলে গিয়েছেন রবিবার থেকে। পুলিশ সূত্রের দাবি, দিন কয়েক আগেই তিনি ছুটির আবেদন জানিয়েছিলেন। সেই মতো ৩১ অগস্ট থেকে তাঁর দু’-তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর হয়েছিল। কিন্তু শনিবার রাতে পুলিশ কমিশনার পচনন্দা তাঁকে বলেন অবিলম্বে তিরিশ দিনের অর্জিত ছুটি (আর্নড লিভ) নিতে। তার পরেই এ দিন থেকে দেবেন্দ্রপ্রকাশ ছুটিতে যান। নির্দেশ দেওয়ার আগে মুখ্যসচিব সমর ঘোষ ও স্বরাষ্ট্র-সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘটনাটি নিয়ে সিপি’র আলোচনা হয়। কার্তিকবাবুর বাড়ি যে হেতু বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের অধীন বাগুইআটি থানা-এলাকায়, তাই বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারও আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বলে লালবাজার-সূত্রের খবর।
দেবেন্দ্রপ্রকাশের জায়গায় আপাতত তিরিশ দিনের জন্য ডিসি (সাউথ)-এর দায়িত্বে পাঠানো হয়েছে ডিসি (নর্থ) গৌরব শর্মাকে। ডিসি (নর্থ)-এর দায়িত্ব নিয়েছেন কলকাতা সশস্ত্র পুলিশের দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়নের ডিসি রবীন্দ্রনাথ সরকার। কার্তিকবাবুর অভিযোগের ভিত্তিতেই কি দেবেন্দ্রপ্রকাশকে নির্দিষ্ট সময়ের আগে ছুটিতে যেতে বলা হল?
পুলিশমহলে এখন এই প্রশ্ন উঠেছে। যার সঙ্গত কারণও রয়েছে। কারণ, সাধারণত এক জন আইপিএস অফিসার ছুটিতে গেলে অন্য এক আইপিএস তাঁর পদের ‘অতিরিক্ত’ দায়িত্বভার নেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সাময়িক ভাবে হলেও গৌরব শর্মাকে ‘অতিরিক্ত’ দায়িত্বভার অর্পণের পরিবর্তে শুধু দেবেন্দ্রপ্রকাশের কার্যভার সামলাতেই পাঠানো হয়েছে। নিয়মের ব্যতিক্রম কেন হল, তার সদুত্তর মেলেনি। এ প্রসঙ্গে লালবাজারের কর্তারা মুখে কুলুপ এটেছেন।
এ দিকে শ্রমমন্ত্রী তথা এলাকার বিধায়ক পূর্ণেন্দুবাবু এ দিন সকালে কার্তিকবাবুর বিদ্যাসাগরপল্লির ফ্ল্যাটে যান। তাঁর পরিজনদের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। পরে মন্ত্রী বলেন, “সমবেদনা জানাতেই গিয়েছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী ওঁর পরিবারকে সাহায্যদানের বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছেন।”
কিন্তু কার্তিকবাবুর অপমৃত্যুর পিছনে ‘উপরওয়ালার তিরস্কার’ কতটা কাজ করেছে, সেই সংশয়ের পাশাপাশি ঘটনাটি ঘিরে আর একটা প্রশ্ন দানা বেঁধেছে পুলিশ মহলে। তা হল: ঊর্ধ্বতন অফিসার যদি কিছু কড়া কথা শোনানও, তার জন্য আত্মহত্যা করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত? বিশেষত চাকরিটা যেখানে পুলিশের?
কার্তিকবাবুর সহকর্মীদেরই কেউ কেউ প্রশ্নটা তুলেছেন। তাঁদের বক্তব্য: পুলিশের চাকরি যে অন্য আর পাঁচটা চাকরির মতো নয়, তা জেনেই সবাই আসেন। পেশাগত সমস্যার কথা সকলেরই জানা থাকা উচিত। ওঁদের দাবি, পুলিশের চাকরিতে এমনিতেই চাপ অনেক বেশি, উপরন্তু সম্প্রতি তদন্তে ‘ঢিলেমি’ নিয়ে আদালতের সমালোচনার পরে তা আরও বেড়েছে। কেস ডায়েরি লেখা এবং চার্জশিট তৈরিতে পুলিশকর্মীদের আরও সক্রিয় হতে বলে থানায় থানায় নির্দেশ পাঠিয়েছে লালবাজার।
এবং কার্তিকবাবু এই চাপটা নিতে পারছিলেন না বলে তাঁর সহকর্মীদের একাংশের ইঙ্গিত। তাঁরা জানিয়েছেন, চেতলা থানা থেকে মাস চারেক আগে পার্ক স্ট্রিটে বদলি হয়ে আসা ওই এসআই হাসিখুশি, নির্বিরোধী মানুষ ছিলেন। কিন্তু গত ক’বছর যাবৎ তদন্তের কাজ সময়ে শেষ করতে পারছিলেন না। পুলিশ-সূত্রের খবর: চেতলায় থাকাকালীন কার্তিকবাবুর হাতে অনেকগুলো কেস ছিল। তার মধ্যে ছিল আত্মহত্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও, যেগুলোর ‘কেস ডায়েরি’ কোর্টে পাঠানোর তাড়া থাকে। তাই আগেও তাঁকে তাড়া দিয়েছিলেন ঊর্ধ্বতন অফিসারেরা। কারণ, তদন্তকারী অফিসার (অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাব-ইন্সপেক্টর বা এসআই) সময়মতো ‘কেস ডায়েরি’ না-পাঠালে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ও বিভাগীয় ডিসি-কে আদালতের কাছে কৈফিয়ত দিতে হয়।
পুলিশের একটি মহলের দাবি, এ বারও তদন্তের কাজে নিয়মমাফিক ‘তাগাদা’ দিতেই গত ৩ অগস্ট কার্তিকবাবুকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন দেবেন্দ্রপ্রকাশ, ‘অপমান’ করার উদ্দেশ্যে নয়। এই মহলের বক্তব্য, পুলিশের কাজে উপরওয়ালার কাছ থেকে এমন চাপ বা তাগাদা আসাটা স্বাভাবিক, কারণ ওই ‘উপরওয়ালা’কেও তাঁর ঊর্ধ্বতনের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। পাশাপাশি বাড়তি সময় ডিউটি করাটাও পুলিশের চাকরির অঙ্গ। সাব-ইন্সপেক্টরদের এই যাবতীয় চাপ সামলিয়েই কাজ করতে হয় বলে অভিমত পুলিশকর্মীদের একাংশের।
মাস কয়েক আগে সার্ভিস রিভলভার থেকে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন পূর্ব যাদবপুর থানার এক সাব-ইন্সপেক্টর। তিনিও ‘কাজের চাপ’কেই দায়ী করেছিলেন বলে তদন্তে জানা যায়। |