বিনোদন: পুজোয় আসছে লোকসঙ্গীতের অ্যালবাম
বন্দিত্বের বেড়ি থেকে মুক্তি খোঁজার গান
সাত বছর জেল খাটার পর গ্রামে ফিরে অবাক হয়ে গিয়েছেন মানুষটি। আশপাশের লোকজন তাঁকে কী ভাবে গ্রহণ করবেন, তাই নিয়ে অনেক সংশয় ছিল। কিন্তু বাঁকুড়া বৈকুণ্ঠপুরের শান্তনু বাগচিকে কেউ কটু কথা বলেননি। বরং সবাই বলেছেন, “তুমি তো জেল খাটতে যাওনি, গান শিখতে গিয়েছিলে!”
বাস্তবিক, জেলে থেকেই গান গাইতে শিখেছেন শান্তনু। গানের অনুষ্ঠানও করেছেন। এখন তাঁর প্রধান পরিচয়, তিনি পেশাদার সঙ্গীতশিল্পী। বাড়ি ফেরার পর ইতিমধ্যেই আট-আটটি অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার ডাক পেয়েছেন। এ সবের পিছনে আছে শিল্পী তপন রায়ের প্রশিক্ষণে বন্দিদের গানের দল ‘মুক্তবেড়ি’তে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা।
আলিপুর জেলের ভিতরে কয়েক বছর আগেই তৈরি হয়েছিল নৃত্যনাটকের দল। নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়ের তত্ত্বাবধানে মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’। সেখান থেকেই সংশোধনাগারের বন্দিদের নিয়ে সংস্কৃতির আঙিনায় জয়যাত্রা শুরু। বাল্মীকির চরিত্রাভিনেতা নাইজেল আকারা এ মুহূর্তে অন্যতম চর্চিত নাম। হালে মুক্তি পাওয়া ‘মুক্তধারা’ ছবির নায়কও। এ বার ‘মুক্তবেড়ি’র হাত ধরে উঠে আসছেন আরও অনেক ‘নাইজেল’ সুজিত দলুই, স্বপন বারুই, মানিক কুমার, গিরিধারী কুমার, পরিমেশ তাপালি, পরিতোষ ঘোষ, স্বপন সর্দার, শান্তনু বাগচি এবং সহদেব সরকার। এ বছর পুজোয় প্রকাশিত হতে চলেছে তাঁদের গাওয়া লোকগানের অ্যালবাম, ‘ওরে মানুষ’।
নতুন জীবনের সুরে। জেল সুপারের ঘরে গানের মহড়া। নিজস্ব চিত্র
প্রাক্তন আইজি (কারা) বংশীধর শর্মার উদ্যোগে আলিপুর সংশোধনাগারে অলকানন্দা বন্দিদের নাচের তালিম দেওয়া শুরু করেছিলেন। ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’র সাফল্যের পর শর্মার উদ্যোগেই অন্য সংশোধনাগারগুলিতেও সাংস্কৃতিক কাজকর্ম শুরু হয়। ‘মুক্তবেড়ি’র সঙ্গীতশিক্ষক তপন রায় বলেন, “বাল্মীকিপ্রতিভা যখন বাইরে মঞ্চস্থ হয়ে সাফল্য পেল, তখন বি ডি শর্মা আমাকে ডেকে পাঠান দমদম সংশোধনাগারে গান নিয়ে কাজ করার জন্য। আজ দু’বছরের মাথায় এই জায়গায় পৌঁছে আমি নিজে খুব আনন্দিত।” আনন্দিত বংশীধরবাবুও। তাঁর কথায়, “আমরা সকলকেই ভাল চিন্তাভাবনার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।” এই অ্যালবামে তিনি নিজে গান গেয়েছেন। এই অ্যালবাম থেকে প্রাপ্য রয়্যালটির টাকা সংশোধনাগারের বন্দি-কল্যাণ তহবিলে দেওয়া হবে।
গানের দলে শুধু দমদম জেলের বন্দিরাই নেই কিন্তু। পরিমেশ তাপালি, পরিতোষ ঘোষ, ও স্বপন সর্দার দমদমের আবাসিক হলেও স্বপন বারুই, মানিক কুমার এবং গিরিধারী কুমার এসেছেন পূর্ব মেদিনীপুর থেকে। বহরমপুর থেকে আনা হয় সুজিত দলুই এবং শান্তনু বাগচিকে। শান্তনু ছাড়া পাওয়ার পরে রায়গঞ্জ থেকে আনা হয়েছে সহদেব সরকারকে। দমদম সংশোধনাগারে ওঁরা এখন একই ঘরে থাকেন। গানের মহড়া দেন। সংশোধনাগারের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসার প্রসূন মাঝি বললেন, “বন্দিদের প্রতিদিন কিছু না কিছু কাজ করতে হয়। তার বিনিময়ে তাঁরা পারিশ্রমিক পান। এঁদের ক্ষেত্রে গান করাটাই সেই কাজ হিসেবে ধরা হয়।” বন্দিরা রেডিও শোনেন এমনিতেই। সংশোধনাগারে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় টিভিও আছে। গানের দল তাঁদের ঘরে একটি টিভি পেয়েছেন। ওঁদের জন্য একটি সিডি প্লেয়ারের ব্যবস্থা করার কথাও ভাবছেন তপনবাবু।
দলটি গড়া হল কী ভাবে? দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের সুপার দেবাশিস মুখোপাধ্যায় এর আগে বহরমপুর জেলে ছিলেন। তিনি বলছেন, “বহরমপুর জেলে নাটকের দল ছিল। দমদমে আসার পর বি ডি শর্মা প্রস্তাব রাখলেন এখানেও তেমন কিছু করা হোক।” তপনবাবু গান শেখানোর দায়িত্ব নিলেন। গাইয়ে মিলবে কী ভাবে? রাজ্যের বিভিন্ন সংশোধনাগারেই ইদানীং নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। বন্দিরা নাচ-গান-নাটকে অংশ নেন। কোন জেলে কারা গান গাইতে পারেন, তার একটা প্রাথমিক তালিকা জেল কর্তৃপক্ষকে দিয়েই তৈরি করানো হল। তপনবাবু বিভিন্ন জেল ‘ভিজিট’ করে সম্ভাব্য গাইয়েদের ‘অডিশন’ নিলেন। তার ভিত্তিতেই গড়ে উঠল দল।
আরও একটি বিষয় মাথায় রাখা হয়েছিল বলে জেল সূত্রের খবর। দল ধরে রাখার স্বার্থে মূলত যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘ কারাবাসের যন্ত্রণাও তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি। মেয়াদি সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন কেবল শান্তনু। ‘মুক্তবেড়ি’র বাকিরা সকলেই যাবজ্জীবনের আসামি, সকলেই খুনের মামলায় জড়িত।
আর প্রায় সকলেই গ্রামের বাসিন্দা। লোকসঙ্গীত, বাউল, ভাটিয়ালি, কীর্তনের সুর এঁদের কানে বাজে। পরিতোষ ঘোষ যেমন, নদিয়ার ধুবুলিয়ার মানুষ। বাড়িতে কীর্তন গানের রেওয়াজ ছিল। শান্তিনিকেতনের ভুবনডাঙা গ্রামের সুজিত দলুই। বাউলাঙ্গের গান তাঁর গলায় সহজে ফোটে। রায়গঞ্জের সহদেব সরকার শিক্ষিত যুবা। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, আধুনিক গান শোনা অভ্যাস ছিল। কাকদ্বীপের স্বপন বারুই বললেন, “ছোটবেলা থেকে একটু-আধটু গান শিখেছি। পাড়ার অনুষ্ঠানে গেয়েওছি। কিন্তু ভাল করে শেখার সুযোগ পেলাম দমদম সংশোধনাগারে এসেই।” লোকসঙ্গীতের তালিম নিতে গিয়ে নিয়ম করে লোকসঙ্গীত শোনাও শুরু হল। আব্বাসউদ্দিন, গোষ্ঠ গোপাল দাস, পূর্ণদাস বাউলের পাশাপাশি রেডিওয় অনুরোধের আসরে ব্যান্ডের গানও এখন শোনেন ওঁরা।
এমন সব কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার পরে সংশোধনাগারের ভিতরের পরিবেশ যত দিন যাচ্ছে, পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তন হচ্ছে বন্দিদের মানসিকতা। বদলে যাচ্ছে দৈনন্দিন রুটিন। ‘মুক্তবেড়ি’র গান শোনার পর দমদমেরই অনেক বন্দি প্রস্তাব রেখেছেন, তাঁদের নাচের তালিম দেওয়া হোক। “যাঁদের মধ্যে ইচ্ছা রয়েছে, তাঁদেরকেই আমরা মোটিভেট করতে পারি”, বললেন দমদমের সুপার দেবাশিসবাবু। বর্তমান আইজি (কারা) রণবীর কুমারও আশাবাদী। তিনি বলেন, “অপরাধীদের মধ্যে অনেক গুণ থাকে। আমাদের কাজ বিভিন্ন থেরাপির মাধ্যমে তাদের সেই গুণগুলো তুলে ধরা।”
তুলে ধরা কারাগারের চার দেওয়ালের বাইরেও। ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ দর্শকদের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিল। বন্দিদের নিয়ে একটি ফুটবল লিগ চালু করার ভাবনা চলছে। আর দু’বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ‘মুক্তবেড়ি’র প্রথম আত্মপ্রকাশ এ বছরের প্রগতি উৎসবে। তার পরে এঁরা আরও তিন বার কারাগারের বাইরে বেরিয়ে মাতিয়ে তুলেছেন দর্শকদের। এ বার পুজোয় আসছে গানের সিডি। ‘সারেগামা’ সংস্থার পূর্বাঞ্চলের কনটেন্ট ম্যানেজার এস এফ করিম বললেন, “আগেও আমরা প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারের বন্দিদের নিয়ে কবিতার সিডি করেছি। ‘মুক্তবেড়ি’র গান শুনে ভাল লেগেছিল। বাণিজ্যিক লাভের থেকেও নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই সিডি প্রকাশের সিদ্ধান্ত।” ‘মুক্তবেড়ি’র গায়কদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন নাইজেল আকারা-ও। “মুক্তবেড়ি ভাল গানের দল। এ ধরনের কাজ দর্শকদের সামনে এলে বন্দিরা উৎসাহ পান। পরে সংশোধনাগার থেকে বেরিয়ে সেটা কাজে লাগাতে পারেন।”
কারাগারের পিছনে থেকে গান শেখা, বাইরে মঞ্চস্থ করা আবার পুজোয় সিডি প্রকাশ হওয়া বন্দিরা নিজেরা কতটা খুশি? একটু থেমে স্বপন বারুই বলেন, “বাড়ির সকলের কথা খুব মনে পড়ে। যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছি। গানের মধ্যে সেই যন্ত্রণা খানিকটা ভোলার চেষ্টা করি।”
নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি হয়েছিল সুজিত দলুইয়ের। পরে মকুব হয়ে যাবজ্জীবন। সিডি-র একটি গান সুজিতের নিজের লেখা, বাউলাঙ্গের সুর ‘শান্তি পাবি রে মন সর্বক্ষণ, দেখবি যদি আয় কবিগুরুর শান্তিনিকেতন’। গানে গানে বন্ধন টুটে যাওয়ার কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অতীতের অপরাধ আর কারাগারের শিকল ভুলে গানেই শান্তি খুঁজছেন ভুবনডাঙার ছেলেটি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.