পড়ার খরচ জোগাতে ভিক্ষার পণ
প্রতিবন্ধীর দিশারি দুই দৃষ্টিহীন
নাদনঘাট বাজারে গান গাইছেন সুরজিৎ ও সবিতা। পাশে বসে আমিনা। দু’চোখে আলো নেই। তবু বাইরে তাকানোর অন্তরটুকু আছে। পড়াশোনা করতে না পারার যন্ত্রণা আর অনটনের কষ্টও ওঁদের খুব চেনা। তাই সম্পূর্ণ অচেনা এক প্রতিবন্ধী তরুণীর পড়াশোনা স্রেফ অভাবের তাড়নায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে জানার পরে আর বসে থাকতে পারেননি দৃষ্টিহীন দুই যুবক-যুবতী সুরজিৎ ও সবিতা। হাটে-বাজারে গান শুনিয়ে টাকা তুলতে নেমেছেন। পণ করেছেন, এ ভাবেই কলেজে পড়ার খরচ জোগাবেন আমিনা খাতুনের।
রবিবার বর্ধমানের নাদনঘাটে গান শুনিয়ে এক সকালের রোজগার সাড়ে সাত হাজার টাকা যখন সুরজিতেরা আমিনার হাতে তুলে দিলেন, চোখের জল বাঁধ মানেনি তিন জনেরই। পূর্বস্থলীর বিদ্যানগর গ্রামের বছর পঁয়ত্রিশের সুরজিৎ সূত্রধর জন্মান্ধ। পেটের টানে লোকাল ট্রেনে গান গেয়ে ভিক্ষা করেন। পূর্বস্থলীরই মধ্য শ্রীরামপুরের সবিতা বীর নবদ্বীপ বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। তার পরে মাথায় টিউমার ধরা পড়ে। গরিব বাবা-মা ভাল করে চিকিৎসা করাতে পারেননি। ধীরে ধীরে আঁধার নামে তাঁর দু’চোখে। এখন বাড়িতেই গানবাজনা নিয়ে দিন কাটে বছর বত্রিশের এই যুবতীর। এলাকায় নানা অনুষ্ঠানে গান গাইতে ডাক পাওয়ার সুবাদেই আলাপ হয় সুরজিৎ-সবিতার। দিন কয়েক আগে এমনই এক অনুষ্ঠানে গিয়ে তাঁরা শোনেন, স্থানীয় আকবপুর গ্রামের আমিনার কথা।
—নিজস্ব চিত্র।
জন্মের পর থেকেই পঙ্গু বছর আঠারোর আমিনা। চলাফেরায় ভরসা হুইলচেয়ার। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা যান। দিদি-জামাইবাবুর কাছেই মানুষ। দিদি রোজিমা বিবি বিড়ি বাঁধেন। জামাইবাবু রাঘুব শেখ দিনমজুর। এ বছরই নাদনঘাট রামপুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে মন্তেশ্বরের গৌড়মোহন কলেজের কলা বিভাগে ভর্তি হন আমিনা। রোজিমা বিবি বলছিলেন, “সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। পড়তে ভালবাসে বলে বোনকে এ পর্যন্ত পড়িয়েছি। কলেজে যাতায়াত ও পড়াশোনার খরচ আর চালাতে পারছি না।”
আমিনাই জানাচ্ছেন, পড়াশোনা বন্ধ হতে বসায় মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিলেন। লুকোচ্ছেন না, এক সময় বেঁচে থাকাও অর্থহীন বলে মনে হয়েছিল। এ খবর পেয়ে আর দেরি করেননি সুরজিৎ-সবিতা।
রবিবার সকাল ৯টা। নাদনঘাট বাজারে ঢোকার মুখে থমকে দাঁড়াচ্ছিলেন মানুষজন। একটা টেবিলে রাখা হারমোনিয়াম বাজিয়ে দুই দৃষ্টিহীন গাইছেন, ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে’। পাশে হুইলচেয়ারে আর এক তরুণী। ভিড় বাড়তে থাকে। সুরজিৎ যখন গাইছেন, সবিতা বলছেন আমিনার কথা। সবিতা যখন গায়িকা, সুরজিৎ তখন আবেদনকারী। একলপ্তে হাজার ছ’য়েক জোগাড় হয় বাজারেই। পরের গন্তব্য বাসস্ট্যান্ড। সেখানে ওঠে হাজার দেড়েক। সুরজিৎ-সবিতার কথায়, “স্রেফ টাকার অভাবে একটা প্রতিবন্ধী মেয়ের পড়াশোনা থমকে যাবে, মানতে পারিনি। ও যেন সেই সুযোগটুকু পায়, এটা নিশ্চিত করতে হবে বলে একটা জেদ চেপে বসল! দেখবেন, ওর কলেজে পড়ার খরচ আমরা জুগিয়ে যাব। এ দিন তো সবে শুরু হল।”
গলা ধরে আসে আমিনার। কোনও রকমে বলেন, “দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। এ বার ভাল ভাবে পড়াশোনা করে দাদা-দিদির চেষ্টাকে মর্যাদা দিতে হবে।” আঁচলে চোখ ঢেকে রোজিমা বিবি বলেছেন, “আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।”
সুরজিৎ-সবিতা অবশ্য এখানেই থামতে চান না। বলছেন, “আমিনার জন্য আমাদের অন্তত এক লক্ষ টাকা তুলতে হবে। এ জন্য ধাত্রীগ্রাম, সমুদ্রগড়, নসরৎপুরেও গাইতে যাব আমরা। আশা করি, মানুষ সাড়া দেবেন।” তাঁদের উদ্যোগে সামিল হতে আগ্রহী পূর্বস্থলীর (দক্ষিণ) বিধায়ক স্বপন দেবনাথ। বলেছেন, “ওঁদের পাশে আছি।” বেলা গড়ায়। পূর্বস্থলীর পাড়া-মহল্লায় ভেসে যায়, ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.