সল্টলেকের স্বাস্থ্য ভবন থেকে কোনও বেসরকারি হাসপাতালের দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। কোনওটার হয়তো সামান্য কিছু বেশি। কিন্তু ওই দূরত্বে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য পরিকল্পনা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা পৌঁছল না তিন মাসেও!
নির্দেশিকাটি কি?
দেশে সংক্রমণ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক যক্ষ্মাকে ‘নথিভূক্ত’ রোগের তালিকায় (নোটিফায়েবল ডিজিজ) নিয়ে এসেছে গত মে মাসে। ৭ মে সব রাজ্যকে এই মর্মে নির্দেশিকাও পাঠানো হয়েছে। তখনই সল্টলেকে স্বাস্থ্য ভবনে এসেছিল নির্দেশিকাটি। যত দ্রুত সম্ভব তা রাজ্যের সব সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোম, চিকিৎসকদের চেম্বার ও বিভিন্ন প্যাথোলজিক্যাল ক্লিনিকে পাঠানোর কথা ছিল। যাতে কেউ কোনও যক্ষ্মা রোগী পেলে সঙ্গে সঙ্গে তা স্বাস্থ্য দফতরকে জানায়। কী ধরনের যক্ষ্মা হয়েছে, তিনি কোনও চিকিৎসা পেয়েছেন কিনা, কোন পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে যক্ষ্মা নির্ধারিত হয়েছে, সবই জানানোর নিয়ম। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকাটি আসার পর তিন মাস পেরিয়ে গেলেও বেসরকারি জায়গা থেকে একজন যক্ষ্মারোগীর নামও জমা পড়েনি স্বাস্থ্য ভবনে।
কেন এই অবস্থা?
স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাস স্বীকার করছেন, যক্ষ্মা যে ‘নোটিফায়েবল’ হয়েছে, সেই তথ্যটুকুই শুধু স্বাস্থ্য দফতরের ওয়েবসাইটেই রয়ে দিয়েছে। গত তিন মাসে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে পৌঁছে দিতে পারেননি তাঁরা। ভারতে মাল্টি ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট (ওষুধ প্রতিরোধী) যক্ষ্মা যখন ব্যাপক হারে বাড়ছে তখন এই তথ্য জানা দরকার আরও বেশি। কারণ, প্রতিটি কেসের রিপোর্ট পেলে তবেই কোন যক্ষ্মা রোগী মাঝপথে ওষুধ ছেড়ে দিয়েছেন বা কার চিকিৎসা যথাযথ হয়নি, সে সব তথ্য বোঝা যায়। অভিযোগ, পরিস্থিতি এমন হওয়া সত্ত্বেও যক্ষ্মা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি স্বাস্থ্যদফতর। রাজ্যের বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এখনও জানেই না যে যক্ষ্মা নোটিফায়েবল হয়েছে।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, ২০১০ সালে দেশে নতুন ২৩ লক্ষ যক্ষ্মা রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৭৩ হাজার রোগী ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত। প্রতি দিন যক্ষ্মায় দেশে মারা যান অন্তত ১ হাজার জন। তা সত্ত্বেও যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা নিয়ে রাজ্যের এমন টালবাহানা কেন? স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “এত তাড়াহুড়োর কী আছে? সবে তো মাস তিনেক হল যক্ষ্মা নোটিফায়েবল হয়েছে। সবাইকে জানাতে একটু সময় তো দিতেই হবে।”
কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অফিসারেরা বলছেন, “এই সময় দিতে গিয়ে ফল মারাত্মক হতে পারে। এই কয়েক মাসে বেসরকারি ক্ষেত্রে চিকিৎসাধীন যক্ষ্মা রোগীরা নজরদারির বাইরে চলে যাবেন। এঁদের মধ্যে কারও যে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা হবে না, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই।”
স্বাস্থ্যদফতরে যক্ষ্মা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অফিসার রাধারমণ বণিকও জানাচ্ছেন, “বহু বেসরকারি ল্যাবরেটরি বা চিকিৎসক দু’বার রোগীর ভারী কফ বা স্পুটাম নিয়ে পরীক্ষা করে যক্ষ্মা নির্ণয়ের নিয়ম মানছে না। শুধু এক্স-রে বা এমআরআই করেই যক্ষ্মার চিকিৎসা শুরু করে দিচ্ছে। এতে রোগ নির্ণয়তেই ফাঁক থেকে যাচ্ছে। আমরা এখনই বেসরকারি হাসপাতালগুলির সঙ্গে বসতে পারিনি বলে এই সমস্যা মেটানো যায়নি।”
এই অবস্থাতেও স্বাস্থ্য দফতর কেন টালবাহানা করছে তা মাথায় ঢুকছে না রাজ্যের চেস্ট স্পেশ্যালিস্টদের। চিকিৎসক পার্থসারথি ভট্টাচার্য বলেন, “তিন মাস হয়ে গেল স্বাস্থ্য দফতর এখনও জানাতে পারল না যে আমরা কোনও যক্ষ্মার কেস পেলে স্বাস্থ্যভবনে কার কাছে রিপোর্ট করব।” যক্ষ্মা চিকিৎসক আলোকগোপাল ঘোষালের কথায়, “সরকার শুধু ডটস পদ্ধতিতে চিকিৎসার কথা বলেই দায়িত্ব সেরে ফেলে। আমাদের সঙ্গে কখনও কোনও যোগাযোগ করে না। সমন্বয়ের অভাবটা সব দিক থেকেই ক্ষতিকর।”
|