অবশেষে ডায়াবেটিস থেকে মুক্তির একটি পথ খুঁজে পেলেন গবেষকরা। আর সেই সাফল্য এল ন’জন বাঙালি বিজ্ঞানীর হাত ধরে।
কলকাতা, দিল্লি, শান্তিনিকেতন ও যোরহাটের পাঁচটি গবেষণা সংস্থার ওই নয় গবেষক যৌথ ভাবে এমন একটি গবেষণা করেছেন, যা ভবিষ্যতে বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস থেকে মুক্তির পথ প্রশস্ত করতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন দেশ-বিদেশের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞরা। ন’জন গবেষকের সম্মিলিত গবেষণাপত্রটি অগস্ট মাসের ‘নেচার মেডিসিন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
বিশ্ব জুড়ে বহু মানুষের মৃত্যু, এমনকী অকালমৃত্যু ডেকে আনে ডায়াবেটিস। বিশেষ করে ইনসুলিন-প্রতিরোধী ডায়াবেটিস যে ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা শঙ্কিত। এই ধরনের ডায়াবেটিসে রক্তে শর্করা ও ইনসুলিন দুইয়ের মাত্রাই বেশি থাকে। কিন্তু ইনসুলিন তার কাজটি (রক্তের শর্করা কমানো) করে উঠতে পারে না। দেখা গিয়েছে দেহের চর্বিকোষে অতিরিক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড জমে গেলে এক দিকে ওজন বেড়ে যায়, অন্য দিকে ইনসুলিনের সক্রিয়তা কমে। রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ছে দেখে অগ্ন্যাশয় ইনসুলিনের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ফ্যাটি অ্যাসিড থেকে সাইটোকাইন নামে একটি পদার্থ নির্গত হয় যা সেই ইনসুলিনকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। ফলে রক্তে শর্করা ও ইনসুলিন উভয়ের মাত্রাই বাড়তে থাকে। কিন্তু ইনসুলিন তার নির্দিষ্ট কাজটুকু (রক্তে শর্করা কমানো) করে উঠতে পারে না। একটা পর্যায়ে এসে যা ‘ডায়াবেটিস-২’ রোগে পরিণত হয়। এই পরিস্থিতির মূলে থাকে চর্বিকোষে অতিরিক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড জমে যাওয়া। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, যাঁরা ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তাঁদের শতকরা ৮০ শতাংশেরই রোগের কারণ চর্বিকোষে অতিরিক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড।
চর্বিকোষে বাড়তি ফ্যাটি অ্যাসিড ঢুকিয়ে দেওয়ার পিছনে ‘ভিলেন’টি কে? তারই খোঁজ দিয়েছেন নয় বাঙালি গবেষক। চিকিৎসা ও জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্বের অগ্রণী পত্রিকা ‘নেচার মেডিসিন’-এ তাঁদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তাঁদের বক্তব্য, লিভারে তৈরি হওয়া একটি গ্লাইকোপ্রোটিন চর্বিকোষগুলিতে ফ্যাটি অ্যাসিডের প্রবেশকে ত্বরান্বিত করে। এর নাম ফেটুয়িন-এ বা সংক্ষেপে ‘ফেট-এ’। এই গ্লাইকোপ্রোটিনের পরিমাণ কমিয়ে দিলে দেখা যায় চর্বিকোষে ফ্যাটি অ্যাসিড ঢুকতে পারছে না। তার ফলে ইনসুলিন ফের সক্রিয় হচ্ছে। ডায়াবেটিসের শঙ্কা কমে যাচ্ছে।
এই গবেষণার অন্যতম গবেষক কলকাতার ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইপিজিএমইআর)-এর অধ্যাপক সতীনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “বহু দিন ধরেই ‘ফেট-এ’-র উপস্থিতির কথা আমাদের জানা। পাওয়া গিয়েছিল বহু দিন আগেই। কিন্তু তা যে ফ্যাটি অ্যাসিডকে নিয়ে গিয়ে চর্বিকোষের ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে সাহায্য করে সেটা জানা ছিল না। চর্বিকোষের পর্দায় ফ্যাটি অ্যাসিডকে গ্রহণ করার জন্য এক ধরনের গ্রাহক রয়েছে। তার নাম ‘টিএলআর-ফোর’। আমরা দেখেছি ‘ফেট-এ’ ছাড়া ফ্যাটি অ্যাসিড ওই গ্রাহকের সঙ্গে আবদ্ধ হতে পারে না। ‘ফেট-এ’-কে নিষ্ক্রিয় করে দিলে ফ্যাটি অ্যাসিড আর ঢুকতে পারে না চর্বিকোষে।”
ওই গবেষণার অন্য এক কাণ্ডারী বিশ্বভারতীর স্কুল অফ লাইফ সায়েন্সের সেলুলার অ্যান্ড এন্ডোক্রিনোলজি ল্যাবরেটরির প্রধান সমীর ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ‘ফেট-এ’-কে এক সঙ্গে এবং আলাদা আলাদা করে ইঁদুরের চর্বিকোষে প্রয়োগ করে দেখেছি যখন ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ‘ফেট-এ’ এক সঙ্গে থাকছে, তখনই কোষের মধ্যে ফ্যাটি অ্যাসিড ঢুকছে। ‘ফেট-এ’ নিষ্ক্রিয় করে দিলে ফ্যাটি অ্যাসিড আর ঢুকতে পারছে না চর্বিকোষে। বারবার পরীক্ষার পরে আমরা ‘ফেট-এ’-র কাজ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি।”
সমীরবাবুদের তাই দাবি, কোনও ওষুধ প্রয়োগ করে ‘ফেট-এ’-কে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া গেলে ফ্যাটি অ্যাসিড প্রভাবিত ইনসুলিন প্রতিরোধী ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হল এক কথায় ‘ফেট-এ’-কে ‘ভিলেন’ ধরে নিয়ে তাকে খতম বা নিষ্ক্রিয় করে দিলেও চলবে না। শরীরে এর কিছু ভাল ভূমিকাও আছে। সতীনাথবাবুর কথায়, “দেহে বাইরে থেকে ঢোকা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া কিংবা অন্য প্রোটিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে ‘ফেট-এ’। চর্বিকোষের পাশাপাশি তাই শরীরে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলা টি-সেলেও অতিরিক্ত মাত্রায় ‘ফেট-এ’ থাকে। আমরা যে ইঁদুরগুলিকে দিয়ে কাজ করেছি তারা ‘ফেট-এ’-মুক্ত হওয়ার পরে সব ধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। শরীরে ‘ফেট-এ’-কে নিষ্ক্রিয় করে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না।”
সে ক্ষেত্রে উপায়টা কী?
সতীনাথবাবু জানাচ্ছেন, কেবল মাত্র চর্বিকোষগুলির ‘ফেট-এ’ বেছে নিয়ে সেগুলিকে কী ভাবে নষ্ট করা যায়, সেই পদ্ধতি এখন খুঁজে বার করা দরকার। অর্থাৎ নয় বাঙালি মিলে ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের একটা পথ দেখালেও সেই পথে বিজ্ঞানকে আরও পথ এগোতে হবে। ডায়াবেটিস চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই গবেষণা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
‘নেচার মেডিসিন’-এ এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া-স্যান দিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের হরমোন বিশেষজ্ঞ জেরয়েড এম ওলেসকি। সতীনাথবাবুদের কাজটিকে ‘পথপ্রদর্শক’ অ্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ফেট-এ’-কে চর্বিকোষের ‘টিএলআর-ফোর’ গ্রাহকের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিশ্চয়ই কোনও পথপদর্শক রয়েছে। সেই পথপ্রদর্শককে খুঁজে বার করে সেটিকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে পারলে শুধু চর্বিকোষের ‘ফেট-এ’ নষ্ট করে ফেলা সম্ভব। সতীনাথবাবুর মন্তব্য, “এখন আমাদের লক্ষ্য হবে ওলেসকি-র সূত্র ধরে ওই ‘পথপ্রদর্শক’-কে খুঁজে বার করা। তা হলেই ডায়াবেটিসের অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে অনেকটা সফল হওয়া যাবে।”
‘নেচার মেডিসিন’-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রটি সম্পর্কে এসএসকেএম হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীর মন্তব্য, “চর্বিকোষে কী ভাবে ফ্যাটি অ্যাসিড প্রবেশ করে, তার হয়তো অনেকগুলি রাস্তা রয়েছে। তার মধ্যে একটি অন্তত এই সমীক্ষায় জানা গেল। চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাছে এটাই একটা বিরাট পদক্ষেপ। এর সূত্র ধরে অজানা তথ্যগুলিও এক সময়ে প্রকাশিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। এ ভাবেই তো বিজ্ঞান কোনও অজানা রহস্যের সমাধান করে।”
ফ্যাটি অ্যাসিড শুধু ডায়াবেটিসই নয়, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদ্রোগেরও অন্যতম কারণ বলে জানাচ্ছেন অভিজিৎবাবু। তাঁর মন্তব্য, “ফ্যাটি অ্যাসিডের কোষে ঢোকা বন্ধ করা গেলে তা হবে বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে অন্যতম অগ্রগতি।”
এন্ডোক্রিনোলজিস্ট আশিস বসুর কথায়, “ফ্যাটি অ্যাসিড থেকে যে গ্লাইকোপ্রোটিন ‘ফেট-এ’ বেরোয়, তা ইনসুলিনের কাজে বাধা দেয়। এর মোকাবিলায় বেশ কিছু দিক নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। তার মধ্যে এটিও একটি। এই আবিষ্কারে চিকিৎসা জগতে অবশ্যই নতুন দিক খুলে যাবে।”
|
নবরত্ন |
সমীর ভট্টাচার্য |
সুদীপ্ত মৈত্র |
দূর্বা পাল |
রাকেশ কুণ্ডু |
|
সেলুলার অ্যান্ড মলিকিউলার এন্ডোক্রিনোলজি
ল্যাবরেটরি
বিশ্বভারতী |
সুকান্ত রায়
|
সতীনাথ মুখোপাধ্যায় |
|
ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন
অ্যান্ড রিসার্চ, এসএসকেএম
কলকাতা |
গোবর্ধন দাস
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি
নয়াদিল্লি |
সুমন দাশগুপ্ত |
সুবীর মজুমদার |
নর্থ-ইস্ট ইনস্টিটিউট অফ
সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি
যোরহাট |
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট
অফ ইমিউনোলজি
নয়াদিল্লি |
|