মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোকাবিলায় প্রমীলা বাহিনী গড়ার চেষ্টায় নামল সিপিএম। এই কাজে প্রথম সোপান হিসাবে তারা ব্যবহার করতে চাইছে দলের ছাত্র সংগঠনকে।
আলিপুরদুয়ারে সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের চলতি রাজ্য সম্মেলনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মহিলা ব্রিগেড তৈরির উপরেই। সম্মেলনের সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের পাশাপাশি প্রতিনিধিদের আলোচনাতেও উঠে আসছে মহিলাদের সামনের সারিতে আনার প্রয়োজনীয়তার কথা। প্রতিবেদনে যেমন বলা হয়েছে, ‘রাজ্যে এখন প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। অথচ, মেয়েদের নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে। চাই প্রতিরোধ। রাজ্য জুড়ে নৈরাজ্য মোকাবিলায় চাই ছাত্র এবং বিশেষত ছাত্রীদের সম্মিলিত প্রতিরোধ’। বস্তুত, তরুণ প্রজন্মের মহিলা মুখকে সামনে আনার গুরুত্ব বুঝেই আলিমুদ্দিনও সেই মর্মে পদক্ষেপ শুরু করেছে। এই সম্মেলন থেকে এসএফআইয়ের নয়া রাজ্য সভানেত্রী হতে চলছেন মধুজা সেন রায়। নেতৃত্বে মহিলা থাকলে ছাত্রীদের সংগঠনের কাজে আকৃষ্ট করতে সুবিধা হবে বলেই সিপিএম মনে করছে।
তবে মহিলা মুখ এনে ‘মরিয়া’ লড়াইয়ের চেষ্টা করলেও সিপিএমের ছাত্র সংগঠনের পক্ষে পরিস্থিতি যে বিশেষ ‘স্বস্তিদায়ক’ নয়, তাদের সম্মেলন থেকেই তা স্পষ্ট। এত দিন এসএফআই ইউনিট গড়ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধরে। এই সম্মেলন থেকেই নতুন এলাকাভিত্তিক কমিটি (টেরিটোরিয়াল ইউনিট) গড়ার সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, এর পর শুধু প্রতিষ্ঠানের গণ্ডিতে আটকে না থেকে এলাকা ভিত্তিতে কমিটি গড়বে এসএফআই। যা হয়ে থাকে যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের ক্ষেত্রে। সিপিএমের এক রাজ্য নেতার বক্তব্য, “কলেজে কলেজে শাসকদলের সন্ত্রাসের জন্য এসএফআই কর্মীরা বহু জায়গায় কাজ করতে পারছেন না। এলাকা ধরে কমিটি করলে এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুবিধা হবে।” যদিও এলাকা ধরে কমিটি গড়লে এসএফআই এবং ডিওয়াইএফআইয়ের সীমারেখা গুলিয়ে যাবে কিনা, তা নিয়ে দলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠছে।
রাজ্যে ‘পরিবর্তন’-এর পরে এসএফআইয়ের মতো সিপিএমের গণ সংগঠনগুলির কাজ যে কত ‘কঠিন’ হয়ে গিয়েছে, তা-ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে এ বারের সম্মেলনের প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার অভিজ্ঞতা না থাকায় অনেক সময় বিহ্বলতা সৃষ্টি হচ্ছে’। পাশাপাশি, ছাত্র সংসদের রাজনীতিও যে ‘কঠিন’ হয়েছে, তা বোঝাতে ‘ক্যাম্পাসে রাজনীতি বন্ধ করার নতুন নকশা’ শীর্ষক একটি গোটা পরিচ্ছেদই রাখা হয়েছে এসএফআইয়ের সম্মেলনের প্রতিবেদনে।
তবে একইসঙ্গে সিপিএম নেতৃত্ব মনে করছেন, দল ক্ষমতায় থাকার সময় এসএফআইয়ের মধ্যে ‘ছাত্র সংসদ-সর্বস্বতা’ তৈরি হয়ে তাদের ক্ষতি করেছিল। এখন পরিস্থিতির চাপে ছাত্র সংসদের বাইরে বেরিয়ে এলাকা ভিত্তিতে এসএফআইয়ের ইউনিট তৈরি হলে ছাত্র-কর্মীদের ‘রাজনৈতিক সচেতনতা’ বাড়বে।
কিন্তু ৬০ পাতার প্রতিবেদনে সংগঠনের ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে কোনও আলোচনা নেই! অথচ, তরুণ মুখদের নেতৃত্বে তুলে আনা নিয়ে দলের অন্দরে কিছু প্রশ্ন মাথাচাড়া দিচ্ছে এবং তা গণ সংগঠনের ‘স্বাধীন’ ভাবে কাজ করা প্রসঙ্গেই। যেমন এসএফআইয়ের বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ মিত্রকে ডিওয়াইএফআইয়ের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক করা হয়েছে। সিপিএমের রাজ্য কমিটির এক সদস্যের প্রশ্ন, “২০০৬ সালে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি একটি নথিতে বলেছিল, ছাত্র ও যুবর মতো গণ সংগঠনগুলি যথাসম্ভব স্বাধীন ভাবে কাজ করবে। কিন্তু বাস্তবে দলের বিভিন্ন নেতার পছন্দসই মুখকে গণ সংগঠনের মাথায় বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে।” এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক হিসাবেই ছ’ মাস আগে সায়নদীপ সিপিএমের রাজ্য কমিটিতে ফের জায়গা পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ডিওয়াইএফআই করেননি। তবু তাঁকে সেই সংগঠনে এনে সরাসরি উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক করে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে দলে। প্রসঙ্গত, দলের জেলা রাজনীতিতে সায়নদীপ গৌতম দেবের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতমবাবু যে ভাবে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক হয়েছেন, তাঁর ‘অনুগামী’ তরুণ নেতাদের ক্ষেত্রেও সেই ‘মডেল’ অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা, দলে চর্চা চলছে তা নিয়েই। ডিওয়াইএফআইয়ের সম্মেলনে নতুন রাজ্য সম্পাদক হওয়ার সম্ভাবনা মদন ঘোষ, নৃপেন চৌধুরীদের পছন্দের এক তরুণ নেতার। আজ, রবিবার বাঁকুড়ায় প্রকাশ্য সমাবেশের মধ্য দিয়ে ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য সম্মেলন শুরু হচ্ছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সেখানে বক্তৃতা করার কথা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় নানা দাওয়াই নিয়ে ভাবনাচিন্তা চললেও নেতার হাত ধরে নেতা হওয়ার সংস্কৃতি সিপিএমে অনেক প্রশ্নেরও জন্ম দিচ্ছে। |