প্রবন্ধ...
ওই পুজো, বাপ রে
সারাটা আলমারি তন্নতন্ন খুঁজেছি। শোকেসের নিবিড়তম কোনা, আঙুলে কী যেন ফুটল। গুলি মারো। টিভির পিছন দিকটা, রান্নাঘরের তাকগুলো। নেই নেই, কোত্থাও নেই। শেষে পাঁচ মিনিটের ইন্টারভাল নিতে, মায়ের বিছানায় ধপাস হতেই, সিগন্যাল এল। ডান দিকটায়। হালকা উঁচু। তার মানে, এখানেই, শিয়োর। এ তোশক, ও গদি উপড়ে ইউরেকা। ৫০২ পাতা, কালি কাগজের গন্ধে মনের তুমুল খিদে পেয়ে যায়, চোখ ভরে দেখি মলাটে রংতুলির মা দুর্গা মহিষাসুরকে কী দারুণ ত্রিশূল ফোটাচ্ছেন। পুজোবার্ষিকী নয়, ওটাই ছিল পুজো।
সেই পুজোর ওপরই চেপে বসে, খেয়ে শুয়ে এবং রাত জেগে পরীক্ষার পড়া করে, ক্লাস থ্রি থেকে টেন সব হুসহুসিয়ে চলে গেছে। তখন থেকে শুনছি পুজো এলে তো মজাই শেষ। তার চাইতে বরং পুজো আসছে, পুজো আসছে এই ওয়েদারটার চার্ম বেশি ফুটফুটে, রোমাঞ্চ আরও সাংঘাতিক। কেমন আস্তে আস্তে বাঁশ পুঁতে তেরপল লাগাবে, কাঠে পেরেক ঠুকে প্যান্ডেল বানাবে, আমি অপুদাদার মতো হাঁ করে আশ্বিনের বৃষ্টি ধোওয়া চকচকে আকাশে তুলো মেঘে হাতি ঘোড়া বা নৌকো-র আউটলাইন খুঁজব। কে জানে মা এ বার কোনটায় চেপে আসবেন!
কিন্তু বড় হতেই আস্ত বেকুব বনে গেলাম। সেই মিষ্টি মতো প্রতীক্ষাটা কোথায়? মা দুর্গাকে আর নিজের মতো করে আসবার সুযোগই দেওয়া হয় না। দেবীপক্ষের তিন মাস বাকি থাকতেই, তাঁকে সপরিবারায় সবাহনায় চ দড়ি দিয়ে টেনেহিঁচড়ে মর্ত্যে নামিয়ে নেওয়া হয়। চার পাশে তড়িঘড়ি একটা কৃত্রিম শরৎকালও বানিয়ে ফেলা হয়। টানা ১০০ দিন সেই কিম্ভূত বস্তু ঘাড়ের কাছে ফোঁসফোঁস করতে থাকে। তাই পুজো আসার দিনগুলো এখন এক ভয়ঙ্কর শাস্তি সেজে অতিষ্ঠ করে মারে।
আমাদের এলগিন রোড, আনোয়ার শাহ-র শপিং মল’রা তো সেই কবে থেকে পুজোর জন্য আস্তিন গোটাচ্ছে। রাষ্ট্রপতি স্বাধীনতা ভাষণের ড্রাফট বানাচ্ছেন, আর সব ক’টা মল তেরঙার পাশে নোটিস টাঙিয়েছে। আপটু ফিফটি পার্সেন্ট অফ। এসো বাঙালি, প্রথমা-দ্বিতীয়ার পুজো পরিক্রমার তরে খান কয় বিদেশি ব্র্যান্ড-এর জামা নিয়ে যাও। তোমরা হুজুগে জাত বলে এত নাম করেছ, আজকাল মহালয়া থেকেই প্যান্ডেল দেখতে বের হয়ে পড়ো। সেই তোমরা পুজোর সময় এল কাছে বলে দু’হাত তুলে অন্তত তিন মাস ধরে না নাচলে মানায়? রেড রোডে প্যারেড শেষ হতেই সিকিউরিটির কাছে ফোন। অমনি দরজায় ঘন ঘন দড়ি, সামনে লাইন বাড়ছে, ভাদ্রের রোদ্দুরে মানুষ দরদর করে ঘামছে, বৃষ্টিতে ভিজছে, তবু মুখে আনন্দামৃত। পুজোর শপিংও হল, এখন ভরা বর্ষায় দড়ি ছিঁড়ে ভিড়ে চটকে ঠাকুর দেখার অভ্যাসটার রিভিশনও হল। দেখলে ১৫ অগস্ট-এর মানে পুরো গুলিয়ে যায়! স্বাধীনতা না পুজো রে ভাই?
ওই যাহ্, ঢাকে কাঠি পড়ে গেল যে। পুরো শহরে এই বেলা ‘পুজোর গন্ধ’ লেখা পারফিউমটা স্প্রে করে দাও দেখি। টিভি চ্যানেলেরা নামের ওপরে বার বার দুর্গা বানাচ্ছে। খড়ের কাঠামোয় মাটি লেপল, চোখ আঁকল, মুকুট হার পরিয়ে ধূপধুনো দিয়ে কমপ্লিট মা জননী। পাঁচ সেকেন্ডে। সেই মূর্তির চালচিত্রের জায়গায় রক্তচাপ বাড়ানো কাউন্টডাউন। অপেক্ষার চুয়ান্ন দিন একুশ ঘণ্টা সতেরো মিনিট সাড়ে এগারো সেকেন্ড বাকি। সে দিকে চোখ গেলেই মাথায় পুজো-স্ট্রেস দাপাদাপি করতে থাকে। হতচ্ছাড়া দরজি গেল বার শাসিয়েছিল, ‘আমরা দু’মাস আগেত্থেকে আর অর্ডার নেই না।’ এ দিকে বিশ্বকর্মা পুজো থেকে ভাইফোঁটা-সরস্বতী পুজো হিসেব করে একুশখানা শাড়ি-ব্লাউজে সেলাই মারতে হবে। কী চাপ! এ বারটা উতরে দাও মা দুর্গা, তোমার নামে দিব্যি করছি, বিসর্জনের পর প্রণাম-মিষ্টির পর্ব চুকলেই মাস্টারজিকে এক গাড়ি শাড়ি দিয়ে আসব। বাপরে বাপ! মোটে তিনশো চৌষট্টি দিন বাকি যে!
পুজোবার্ষিকীরাও ওই জুলাই থেকেই মাঠে নেমে যায়। সন্ধ্যেবেলার মেগা সিরিয়ালের আধ ঘণ্টা তাই শারদসাহিত্য পড়তে হচ্ছে। শুধু পেজমার্কে ধূপের বিজ্ঞাপনে, কাশফুলের ছবি দেখে কোথায় একটা জ্বালা জ্বালা করে। গল্প-উপন্যাসগুলোর প্লট পুজোর ছুটি, অষ্টমীর অঞ্জলির আশপাশে ঘোরে। দশমীর ধুনুচির আড়ালে টিপু সুলতানের হিরে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু এ সব পড়ে কই আর তেমন সুখ মেলে না তো! উত্তেজনাটাও বড় বেতালে বাজে! খুব কাছের কী যেন একটা কোথায় হারিয়ে গেছে, আর কোনও দিন ফিরবে না বলে খুব মন কেমন করে। শ্রাবণের কলকাতার গায়ে আশ্বিনের জামা! ফিট করাতে অতি বড় আপনভোলাও ফেল মেরে যায়।
এফ এম’রা হঠাৎ পুজোর দিকে আরও খানিকটা এগিয়ে গেলেন। পিতৃপক্ষের ঢের আগে যখন তখন কানের গোড়ায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বাজিয়ে দিচ্ছেন। খানিকক্ষণ ‘যা দেবী সর্বভূতেষু... নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ’ করেই ঢ্যামকুড়াকুড় তাক, ঢ্যাং ঢ্যাঙাঢ্যাংঢ্যাঢ্যাং। চোখের সামনে ভোজবাজি। বর্ষার ডামাডোলে ঘেঁটে থাকা ভ্যাপসা শহরটা হঠাৎ করে আলোর মালা পরে মহাষষ্ঠীর কলকাতা হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এ বার প্রিয় তারকার কণ্ঠস্বর, ‘চতুর্থীতে ওপেনিং, ষষ্ঠীতে উঁউঁ আড্ডা বোধ হয়, সপ্তমীতে হুঁমমম, উমম’ কেন? এমন আমতা আমতা কেন? তা এত তাড়াতাড়ি কিছু প্ল্যানই হয়নি তো ইন্টারভিউ দেবেন কোত্থেকে? বিদ্যুৎচমকের মতো সম্বিত ফিরে আসে, ব্যাকগ্রাউন্ডে ঢাকের বাজনা মেলাতেই ষষ্ঠীর সিনটিও ভ্যানিশ। রাস্তা দেখে আঁতকে উঠি! উরিত্তারা, এত জ্যাম কীসের রে? ওই একই জবাব। খোঁড়াখুড়ি চলছে, পথের মাঝে গাছ বসবে, ফুটপাথের সাইডটা ঘিরে মূর্তি হচ্ছে। পুজো আসছে। তন্বীর ডায়েটিং-এ আগমনী, সিজন চেঞ্জ-এর হাঁচিতে আগমনী, মেট্রোর ভিড়ে আগমনী, কনজাঙ্কটিভাইটিস-এর কালো চশমা দেখেও লোক উল্লাসে আটখানা: ওই তো পুজো আসছে।
অগস্টের শেষবেলাতেই ফের এই সব চেনা ছবি দেখছি আর বুক ধড়ফড়িয়ে উঠছে। এর পরেও তো সেপ্টেম্বর আর অক্টোবর হাতে পড়ে! তাই, দোহাই আপনাদের, রেহাই দিন এই ২০১২-কে। পুজো পুজো করে ক্ষেপে না উঠে চুপচাপ গ্যালারিতে বসুন, প্রকৃতি ঠিক নিজের মতো খেলবে। চট করে এক দিন খেয়াল হবে, ওই তো, বারান্দায়! ম্যাজিক রোদটা এসে গেছে। আকাশের দিকে তাকালে নামতে থাকা ক’টা ঘুড়ি চোখে পড়বে বোধ হয়। ক’দিন পর, বাগবাজার সার্বজনীনে, হাফ-তৈরি দুগ্গাঠাকুর এসে টানটান পর্দার আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকবেন। তার পরই এক দিন ভোর রাতে আপনা হতেই ঘুমটা ভেঙে যাবে। বাড়ি বাড়ি থেকে সেই উদাত্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসবে, পাক দিয়ে দিয়ে লালচে আকাশে উঠে, জয়ং দেহি, দ্বিষো জহি হয়ে মিলিয়ে যাবে।
তখনই পুজো আসবে। তাকে ১০০ দিন আগে আনার জন্য কোমর বেঁধে, বছরের আনন্দটা বধ করবেন না। প্লিজ!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.