এত দিন অবধি ইতিহাসের পাতায় আটকে ছিল বাল গঙ্গাধর টিলকের কণ্ঠস্বর। কিন্তু এ বার হয়তো সত্যিই তা শোনা যাবে।
অন্তত সে রকম আশাই দেখাচ্ছে সম্প্রতি উদ্ধার হওয়া একটি টেপ। টিলকের প্রপৌত্র দীপক টিলক জানিয়েছেন, ১৯১৫ সালে একটি গানের উৎসবে টেপ-বন্দি হয়েছিল টিলকের কণ্ঠস্বর। তা-ও কিছুটা কাকতালীয় ভাবেই। দীপকের দাবি, এই রেকর্ডটি আক্ষরিক অর্থেই ‘অদ্বিতীয়’। সম্প্রতি এটির সন্ধান মিলেছে করাচি থেকে।
স্বাধীনতার আগে টিলকের আওয়াজ উত্তাল করেছিল অবিভক্ত ভারতের প্রায় সব অংশকেই। করাচিও ছিল সেই অবিভক্ত ভারতের অংশ। কিন্তু সাতচল্লিশ সালের পর বদলে যায় অনেক কিছুই। এ হেন পরিস্থিতিতে প্রায় সাতানব্বই বছর পুরনো ওই টেপ কী ভাবে রাখা হয়েছিল, সেটাই বিস্ময়ের।
দীপক জানাচ্ছেন, এই সংরক্ষণের পিছনে রয়েছেন শেঠ লক্ষ্মীচাঁদ নারঙ্গ নামে এক সঙ্গীতপ্রেমী। আদতে করাচির বাসিন্দা লক্ষ্মীচাঁদ ১৯১৫ সালে ২১ সেপ্টেম্বর গণেশ-উৎসব উপলক্ষে পুণে আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন আমেরিকায় তৈরি একটি রেকর্ডিং যন্ত্র। উদ্দেশ্য ছিল গণেশ উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত একটি গানের অনুষ্ঠান রেকর্ড করা। এটি আয়োজন করা হয়েছিল কেসরী-ওয়াড়ায়। যার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন স্বয়ং বাল গঙ্গাধর টিলক। সূত্রের খবর, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তাবড় ব্যক্তিত্ব, যেমন কৃষ্ণরাও, পণ্ডিত ভাস্করবুয়া বাখালে এবং নারায়ণরাও রাজহংস ওরফে বালগন্ধর্ব নিমন্ত্রিত ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। তাঁদের গান রেকর্ড করতেই করাচি থেকে এসেছিলেন লক্ষ্মীচাঁদ। এবং গানের ফাঁকে ফাঁকে রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল টিলকের কন্ঠস্বরও।
যদিও সে দিন জাতীয়তাবাদের কোনও কথা বলেননি টিলক। বরং অনুষ্ঠানে জমায়েত অশান্ত জনতাকে শান্ত করার জন্য বারবার মাতৃভাষা মরাঠিতে অনুরোধ জানাচ্ছিলেন তিনি। যাঁর বাংলা করলে দাঁড়ায়, “আমি চাই অনুষ্ঠানটা শান্তিতে হোক। এবং তাতে কোনও রকম চিৎকার-চেঁচামেচি সহ্য করব না।” তার পরেই কিছুটা কড়া ভাষায়, “যাঁরা চান বেরিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু অনুষ্ঠান পূর্ব-নির্ধারিত সময় অনুসারেই হবে।”
রেকর্ডটি নিয়ে অনুষ্ঠান শেষে করাচি ফিরে যান লক্ষ্মীচাঁদ। ১৯৩৯ সালে মৃত্যু হয় তাঁর। তার পর থেকে এত দিন পর্যন্ত রেকর্ডটি সযত্নে রাখা ছিল লক্ষ্মীচাঁদের নাতি মুকেশ নারঙ্গের কাছে। যেটি খুঁজে বের করেছেন পণ্ডিত বাখালের নাতি সুহাস দাতার এবং সুধীর দাতার ও নাত-বৌ শৈলজা দাতার।
যদিও সমালোচকরা কিন্তু সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তাঁদের দাবি, ওই টেপে রেকর্ড হওয়া স্বর যে টিলকেরই তার কী প্রমাণ?
হাতেনাতে না হলেও পরোক্ষ প্রমাণ কিন্তু রয়েছে বলে দাবি একাংশের। যেমন কৃষ্ণরাওয়ের বইয়ে হুবহু এই ঘটনারই বর্ণনা রয়েছে। পণ্ডিত বাখালে সম্পর্কিত তথ্যের মধ্যেও এই একই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। ফলে কন্ঠস্বরটি যে আসলে টিলকেরই সে ব্যাপারে একরকম নিশ্চিত দীপক। একই সঙ্গে তাঁর স্বীকারোক্তি, এত দিন অবধি কেসরী ট্রাস্ট গ্রন্থাগারে টিলকের বিভিন্ন লেখার সংগ্রহ ছিল। এ বার সেই সম্ভারে যুক্ত হল টিলকের আওয়াজ। সেই আওয়াজ যা চরম দমন-পীড়নের যুগেও সাহসী হয়ে বলে উঠেছিল ‘স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার।” |