|
|
|
|
|
রোমান্স ও রোমিয়ো |
রোমে আছে কলকাতা। ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি, এঁদো গলি। তাই কি ওরাও শিল্পী? দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকে।
দুপুরবেলায়
রোম-রঞ্জনার বারান্দায় ফুল ঘুমোয়, রাস্তায় সাইকেল রেখে যায় ‘রোমীয়’রা। শুভময় মিত্র |
ফ্লামিনিয়া বলল, ‘খামখা হোটেলে কেন থাকবে, পয়সা নষ্ট। আমার ফ্ল্যাট আছে, কোনও অসুবিধা হবে না, ওখানেই থাকো, যত দিন খুশি থাকো। ফুল কিচেন আছে, গরম জল আসে, তোমাদের দিব্যি হয়ে যাবে, তা ছাড়া তোমরা তো সারা দিন রাস্তায় ঘুরবে।’ ওর বয়ফ্রেন্ড পাওলো মাথা নেড়ে বলল, ‘এখান থেকে ফ্লোরেন্স মাত্র কয়েক ঘণ্টা, ফ্লোরেন্স থেকে রোমও তাই।’ এই সব কথা হচ্ছিল আমাদের অর্ধোন্মাদ ইটালিয়ান বন্ধু লোরেনজোর মিলানের বাড়িতে বসে। আমার স্ত্রীর ভারতীয় স্টাইলের রান্না খেয়ে তারা অভিভূত। এর পরেই এই প্রস্তাব। ফ্লামিনিয়া আরও বলল, ‘আমার মা এলেনা, থাকে একেবারে উল্টো দিকের বাড়িতে। আমি বলে দিচ্ছি, তোমরা চাবি নিয়ে ঢুকে পড়বে।’ সামান্যই আলাপ, একটু গল্পগুজব, অপরিচিতই বলা যায়। অথচ নিজের বাড়ির চাবি তুলে দিচ্ছে এক ভারতীয় দম্পতির হাতে আন্তরিক ভাবে। রীতিমত অস্বস্তি হচ্ছিল, কিছু বললাম না, হাসি হাসি মুখে বসে রইলাম।
ইউরোস্টার সার্ভিসের গ্ল্যামার, স্পিড এবং টিকিটের দাম বেশি। তাই চড়ে বসেছি ট্রেন ইটালিয়া’তে। আমাদের শতাব্দী এক্সপ্রেস-এর মতোই কোচ, তবে চা-সিঙাড়া নিয়ে কেউ ওঠে না। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম-এ দাঁড়ালে দরজায় এক পা রেখে লোকজনকে সিগারেট খেতে দেখা যায়। ইংলিশ প্যাসেঞ্জাররা যেমন বই বা ট্যাবলয়েড নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ইটালিয়ানরা তা নয়। সমানে চলে খাওয়াদাওয়া আর বকরবকর।
হাওড়ায় প্ল্যাটফর্ম পাওয়ার আগে সব ট্রেনই এক বার দাঁড়িয়ে পড়ে। রোমে
ঢোকার সময় তেমন কিছু হল না। হলে
ভাল হত, কারণ অন্যান্য ট্রেনের ইঞ্জিনে, কামরায়, বাড়ির পাঁচিলে সর্বত্র গ্রাফিতি-র ছড়াছড়ি। রঙের ক্যান থেকে সরাসরি স্প্রে করে আঁকা অদ্ভুত সব ছবি। অজানা এক ধরনের অক্ষর দিয়ে তৈরি শব্দ, বাক্য মিশে গেছে ছবির সঙ্গে। মজার জারকে চোবানো ইটালিয়ান বাগবিতণ্ডায় হিউমার উপচে পড়ছে। ভাষা না জানলেও সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না। |
|
রোম টার্মিনি। বিশাল, বিখ্যাত রেল স্টেশন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ডকুমেন্টারি-তে এর চেহারা দেখেছি। ফেদেরিকো ফেলিনি-র সিনেমাতেও আছে, এ বারে স্বচক্ষে। তবে অবাক হলাম না তেমন। আমেরিকার গ্রান্ড সেন্ট্রালের গথিক দম্ভ তো নেই-ই বরং বেশ ছাপোষা হাবভাব। শিয়ালদা স্টেশনের সঙ্গে একটা শপিং মল-এর বিয়ে দিলে যা হত, সেটাই রোম টার্মিনি। পুরো চত্বরটা জামাকাপড়, সানগ্লাস, খাবারদাবার, মদ, গয়নাগাটির দোকানপত্তরে ঠাসা। বিশ্বায়নের অভিশাপে প্রায় সব ব্র্যান্ড-এর নাম জানা থাকায় ও দিকে আর একেবারেই এগোলাম না।
আমার পিঠে ক্যামেরার ব্যাগ। এক হাত ধরে রেখেছে ফেটে পড়ার আগের মুহূর্তের থমকে থাকা সুটকেস। অন্য হাতে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছি চাকাওয়ালা ফ্রেম লাগানো দড়ি দিয়ে বাঁধা বিশাল ভারী একটা প্যাকিং বাক্সোকে। রোমের পকেটমারদের কুখ্যাতি সবর্জনবিদিত। হিপ পকেটে হাত দিতে না পারার অসহায়তা অনুভব করে হাতের তালু ঘেমে উঠল।
স্টেশনের বাইরে বেরোতেই ছেঁকে ধরল ট্যাক্সিওয়ালারা। এ দিক-ও দিক তাকিয়ে প্রি-পেড চোখে পড়ল না। ফ্লামিনিয়ার বাড়ির ঠিকানা আঁকড়ে ধরে আছি হাতে। দেখেই সবাই বলল, ‘যাব’। নির্বিকার ভাবে কেউ হাঁকল ‘ফিফটি ইউরো’, কেউ ‘থার্টি’। গুগ্ল ম্যাপ দেখে রেখেছিলাম আগে। এত ভাড়া হওয়ার কথাই নয়। বললাম, ‘মিটারে যাব’। চার পাশ থেকে আমাদের ঘিরে ধরা দলটা নির্বিকার ভাবে বলল, ‘নো মিটার’। দরাদরি চলতে লাগল। এক জন তো ভাল করে ঠিকানা দেখে বলে বসল ‘সিক্সটি’। যাই দর হাঁকুক রাগারাগি, তর্কাতর্কি করার মানে হয় না বিদেশবিভুঁইয়ে। আমি শুধু দুম করে বলে বসলাম ‘হেঁটেই যাব’। সঙ্গে সঙ্গে সবাই একটুও রাগ না করে দূরের একটা গাড়িকে দেখিয়ে বলল, ‘মিটার’।
ময়লা আবর্জনা, ছেঁড়া ন্যাকড়া, সবজির খোসা, নোংরা প্যাকেট এ সব মুছে দিলে কালীঘাটের গলি যেমন, ঠিক তেমনই জায়গায় নামলাম। পাথর বসানো রাস্তা, শুনশান। গলির দু’পাশে ঠাসা পুরনো বাড়ি, জানলায় আসল ভিনিশিয়ান ব্লাইন্ড। পলেস্তারা খসা দেওয়াল যেন দা ভিঞ্চির অসমাপ্ত ক্যানভাস। প্রায় সব জানলায় বা ছোট্ট বারান্দায় উপচে পড়ছে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। শুনেছি বাড়িতে কুমারী মেয়ে থাকলে বারান্দায় ফুল রাখে তারা। সেই বারান্দার নীচেই ধাপকাটা রাস্তায় সাইকেল রেখে গিয়েছে কোনও অসহিষ্ণু রাজকুমার। আকাশ কালো। এ দিকে রোদ পড়েছে বাড়ির ফাঁক দিয়ে দেখতে পাওয়া রোমান ফোরামে।
‘আরে চাবিটা জোগাড় করো, দাঁড়িয়ে গেলে কেন?’ বাড়ি খুঁজে পেয়েছি, উল্টো পারে লেটার বাক্সর পাশে দরজায় কলিং বেল-এর গায়ে দেখে নিয়েছি লেখা আছে এলেনা বার্নি। বেল বেজে গেল, এলেনা এখন অফিসে। ফোনেও পেলাম না।
কথা অনুযায়ী, ছোট মুদির দোকানে চাবি রেখে যাওয়ার কথা। কিন্তু কোনও দোকানই নেই আশেপাশে। আমার নজর ফুলভরা বারান্দার দিকে। সেখানে সোনালি রোদ ছুঁয়ে যাচ্ছে, রোমের আকাশে-বাতাসে যেন মাইকেল এঞ্জেলোর সূক্ষ্ম স্পর্শ।
আমার মতো চোখে ঝিলমিল-লাগা ঠুঁটো জগন্নাথের ওপর রাগারাগি না করে আমার স্ত্রী আশেপাশে অনেক খোঁজাখুঁজি করলেন। তার পর হতাশ মুখে ফিরে এলেন। উদ্বেগের ছাই রঙা পোঁচটা যখন লাগবে লাগবে করছে, ঠিক তখনই ‘খুট’ করে শব্দ হল কোথাও একটা। চার পাশ দেখেটেখে কিছুই বুঝতে পারলাম না। এর পর একটা চাপা ঘুর ঘুর শব্দ শুনে দেখি, এক চিলতে রোলার শাটার উঠছে আস্তে আস্তে। কিছু একটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কেউ সেটা তুলছে ভেতর থেকে। আধখোলা শাটারের তলা থেকে ফস করে বের হল মাথায় গোলাপি রুমাল বাঁধা গোলগাল এক বুড়ি। ফোকলা মুখ, নানা রকম কথা বলে চলেছে। হাসির সঙ্গে মিশে গিয়ে এক আজব সাউন্ড ট্র্যাক।
আমাদের দিকে তাকিয়েই বলছে। ছোট ছোট গোলাপি হাত নেড়ে ডাকছে আমাদের। সেই হাতে একটিমাত্র চাবি। |
ছবি: লেখক |
অপেক্ষায় থাকব
যাঁরা ‘ভ’ বললেই ভ্রমণ ভাবেন, তাঁরা একটা কাগজ টেনে খসখস করে লিখে
ফেলুন বেড়ানোর অভিজ্ঞতা।
একটু অচেনা, অফ-বিট ঠিকানা আর নতুন,
চমকপ্রদ
ঘটনার বিবরণ হলে
মন্দ হয় না। সঙ্গে দিন আপনার
ফোন নম্বর।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা:
উৎসব, সম্পাদকীয় বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬, প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা- ৭০০০০১।
লেখা মনোনীত
হলে জানিয়ে দেওয়া হবে।
অনুগ্রহ করে ফোনে খবর জানতে চাইবেন না। |
|
|
|
|
|
|