|
|
|
|
|
দারুচিনির বেশে তুমি আসলে কে? |
নজরুলের ছন্দে, কবিরাজি বাক্সে, গৃহিণীর মশলার বয়ামে দারচিনির আদর বিশ্ব জুড়ে। অমলিন সুগন্ধে ভাসে
তার সেই দূরদূরান্তের
ইতিহাস আর বাহাদুরির কিস্সা। মসালা ম্যাজিক-এ দারচিনি |
মুখে দিলে প্রথমটা কিছুই হয় না, মনে হয় কাঠের টুকরো। একটু চাপ দিলেই জিভের আগায় একটা মিষ্টি স্বাদ, একটু ঝালও আর হালকা এক সুগন্ধ। তার পর যদি ধৈর্য রাখতে পারেন, আস্তে আস্তে মাঝে মাঝে একটু একটু করে চাপটা বাড়িয়ে যান, চোখ বুজে অবশ্যই, মন ভাল হয়ে যাবে। আর যদি অধৈর্য হয়ে কচরমচর করে চিবিয়ে ফেলেন কাঠের টুকরোটি, তা হলেও সে আপনাকে দুঃখ দেবে না, নিরাশ করবে না, কেবল জালে আর মিষ্টিতে আপনাকে কিঞ্চিৎ বেসামাল করে তুলবে। কিন্তু নেট ফল, সেই একই আহা! দারচিনি ব্যাপারটাই ভারী মজাদার, বাইরেটা কাঠের মতো কঠিন, ভেতরটা ঠিক যেন ঝাল লজেঞ্জ।
নজরুল লিখেছিলেন বটে,
‘দূরদ্বীপবাসিনী চিনি তোমারে চিনি
দারুচিনির দেশে তুমি বিদেশিনি গো’
কিন্তু আসলে দারচিনি মোটেই বিদেশ থেকে আগত কোনও মশলা নয়। শ্রীলঙ্কা, ভারতেই এর জন্ম।
দারচিনি আসলে কাঠ নয়, তবে তার থেকে খুব দূরেও নয়। এটি একটি গাছের ভেতরের ছাল। গরম মশলার একটি প্রধান উপকরণ হিসাবে ব্যবহার হয়। ভারত, শ্রীলঙ্কা ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অঞ্চলে দারচিনি গাছের চাষ হয়। অনেকের মতে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে মিশর বা চিনে এটি প্রথম পাওয়া যায়। তবে এ নিয়ে দ্বিমত আছে। ওল্ড টেস্টামেন্ট-এ মোজেস-এর মুখে দারচিনির উল্লেখ আছে। একটি গল্পে আছে প্রেমিকা প্রেমিকের সঙ্গে মিলনের পূর্বে পোশাকে দারচিনির সুগন্ধ মেখে নিত। বিশ্বাস ছিল, এতে মিলন গভীর হবে। ইউরোপে ও পশ্চিম এশিয়ায় এ মশলার খুব নাম ছিল, দামও। দামি এবং শ্রেষ্ঠ নজরানা হিসাবে রাজা এবং ঈশ্বরকে নিবেদন করা হত। সাধারণ লোকজন সমাধি অনুষ্ঠানে দারচিনি ব্যবহার করতেন না। কারণ তা ছিল তাঁদের সাধ্যাতীত। তবে সম্রাট নিরো তাঁর স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানে সমস্ত শহরের এক বছরের জমা দারচিনি পুড়িয়েছিলেন।
সে কালে আলেকজান্দ্রিয়া ছিল দারচিনির আমদানি রফতানির প্রধান বন্দর। ক্রুসেড-এর সময় ইউরোপ-এর বাজার থেকে দারচিনি উধাও হয়ে যায়। পর্তুগিজ বণিকরা অবশেষে শ্রীলঙ্কা থেকে দারচিনিকে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেন। ব্রাজিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, মাদাগাস্কার এই সব দেশে দারচিনির চাষ খুব বেড়ে গেছে।
দারচিনির মধ্যে এসেনশিয়াল অয়েল থাকে। দারচিনির গন্ধের কারণ এই এসেনশিয়াল অয়েল। |
ব্যবহার |
বিভিন্ন রান্নায় স্বাদ এবং সুগন্ধ বৃদ্ধির জন্য দারচিনিকে ব্যবহার করি আমরা। মেক্সিকোতে চকলেটে দারচিনি ব্যবহার করা হয়। ইউরোপের বিভিন্ন মিষ্টি, যেমন অ্যাপ্ল পাই, ডোনাট্স, ক্যান্ডি ও লিকারে দারচিনি ব্যবহার করা হয়। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায়, বিশেষত পশ্চিম এশিয়ার নানা অঞ্চলের সমস্ত খাদ্যদ্রব্যে দারচিনির ব্যবহার বহুল প্রচলিত। পারস্যের মানুষ আবার স্যুপের মধ্যে দারচিনির গন্ধ বিশেষ পছন্দ করেন। |
ওষুধে দারচিনির ব্যবহার |
দারচিনি এইচ আই ভি এড্স-এর ওষুধের একটি উপকরণ। অ্যান্টিভাইরাল হিসেবেও দারচিনি বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে লেখা আছে, আধ চা চামচ দারচিনির গুঁড়ো রক্তে কোলেস্টেরলকে কম করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া রক্তে শর্করার ভাগ কম করতে দারচিনিকে নির্দিষ্ট পরিমাণে ব্যবহার করার বিধান দেওয়া আছে আয়ুর্বেদে। যে কোনও ওষুধ বেশি পরিমাণে ব্যবহারের ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। দারচিনির নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যবহার সে ক্ষেত্রে অত্যন্ত ফলদায়ক। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। বাতের ব্যথা কম করতে প্রতি দিন সকালে প্রাতরাশের আগে এক চা চামচ দারচিনি গুঁড়োর সঙ্গে একটি বড় চামচ মধুর মিশ্রণ খুব উপকারী। |
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
|
দারচিনির মধ্যে যে এসেনশিয়াল অয়েল থাকে, সেটি অনেকের সহ্য নাও হতে পারে। ত্বকে একটি জ্বালা অনুভূত হয়। অনেকের ক্ষেত্রে অ্যালার্জি দেখা দেয়, তবে সেটা সংখ্যায় কম। যাঁদের হজমের কোনও সমস্যা আছে বা প্রায়ই যে কোনও কারণে পেটের গণ্ডগোল হয়, তাঁদের দারচিনি না খাওয়াই ভাল বা খেলেও অল্প পরিমাণে খাওয়া ভাল। অনেক সময় দারচিনি বেশি খেলে হার্টের গতি বৃদ্ধি পায়। যাঁরা আগে থেকে কিডনি বা লিভারের ওষুধ খান, তাঁদের দারচিনি না খাওয়াই ভাল। গর্ভবতী মায়েদের পক্ষে দারচিনি খুব ভাল নয়। |
|
|
|
|
|