এমন শহর কোথাও খুঁজে...
জেনুইন খোঁজ পাইনি, তবু আমার বিশ্বাস, কলকাতা ছাড়াও পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই মানিকতলা, বেহালা বা হালতু নামে জায়গা বর্তমান। তবে আর কোথাও যে হাওড়া ব্রিজ নেই, সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত। ওই লোহার কাঠামোটি তুলে অন্য নদীর ওপর বসিয়ে, বা নদীটাকেই ব্রিজ সমেত উপড়ে অন্যত্র বয়ে চলার ব্যবস্থা করা যেতেই পারে, কিন্তু সে তখন আর হাওড়া ব্রিজ থাকবে না। তার জন্য অবিশ্যি ওই পাগলটা দায়ী যে নাক সুড়সুড় করা মাত্র ব্রিজের মাথায় চড়ে কী জানি কার উদ্দেশ্যে ‘মেরা নাম চিনচিন চু’ গেয়ে ফায়ার ব্রিগেডের লোকেরা মই লাগিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এক দিক দিয়ে ওঠামাত্র অন্য দিক দিয়ে সড়সড় করে নেমে ‘আমায় জ্যোতি বসু ডাকছে’ বলে ভিড়ে ভ্যানিশ করে যায়। ওকে তো নিয়ে যাওয়া যাবে না কোথাও। শহরের স্কাইলাইন আঁকা হবে অথচ তাতে হাওড়া ব্রিজ নেই ভাবাই যায় না।
আসলে আর কিছু নয়, ব্রিজের মাঝখানের খাঁজটা কেমন যেন কোলের মতো। ‘আর কত দূর বলো মা’ গোঙাতে গোঙাতে বিপ্লবী, কেরানি, সাহিত্যপ্রেমী ক্লান্ত বাঙালি ও দিকে তাকিয়ে ক্যাঁতা মুড়ি দিয়ে গুঁড়িসুড়ি মেরে চাড্ডি জিরিয়ে নেবার স্বপ্ন দেখে আর কী দিল্লির আইকন দেখুন কেমন কুতুব মিনার, কন্টিনিউয়াসলি পেছনে খোঁচা মেরে দৌড় করাচ্ছে। তা বাদে সিরিয়াস সাহিত্যে, সিনেমায়, ভূতের গল্পে, রাস্তা অবরোধের লেগে প্রশস্ত এলাকা বলতে ওই হাওড়া ব্রিজই আমাদের এক মাত্র সম্বল। সুইসাইড কত্তে হবে? ঘুমের ওষুধ কিনে ফালতু পয়সা নষ্ট করতে চান না? সোজা গিয়ে ব্রিজের রেলিং টপকে ঝাঁপ মারুন।
বৃন্দাবনে যমুনা আছে, তমাল, কদম ইত্যাদি গাছপালা আছে। ‘তেরা পাস কেয়া হ্যায়’ জিজ্ঞেস কল্লে তাই আমরা ধরা গলায় বলি ‘মেরা পাস হাওড়া ব্রিজ হ্যায়’। ওর ‘রিবেট মারা থাম’ আমার কদম বিরিক্ষের ডাল, ওর আড়ালে দাঁড়িয়েই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় কী জানি কী ভেবে বলে ফেলা যায় ‘কাল তোমার বাবার সঙ্গে দেখা কত্তে যাবো বুঁচকি’, আবার মলে পর ওতেই ঝুলিয়ে দিস বাপ বলতেও সে তমাল তরু। নীচে যমুনা। পাশে আর একটা সেতু হয়েছে বটে, তবে সে কেমন যেন ভয়ে চুপসে থাকে সব সময়। ওর ওপর দিয়ে লোক হাঁটে না, ওর তলায় মালিশওলারা দলাইমালাই করে না, ওর তলা দিয়ে স্টিমারে চেপে যেতেও রোমাঞ্চ জাগে না শরীরে। আমাদের জীবন তো শুরু হয় ওই ব্রিজের গোড়ায় হাওয়াই শার্ট আর ধুতি পরে ট্রেন থেকে নেমে সুটকেস হাতে মিড লং শটে দাঁড়িয়ে চার পাশ দেখতে দেখতে। শেষ যেন হয় ওই ব্রিজ ধরেই লং শটে ধোঁয়া ধোঁয়া ও পারে কোথাও একটা মিলিয়ে যাওয়ায়।
যে জাতি গ্যাঁজায় না, সে জাতির রক নেই। গ্যাঁজালেও যে নসিবে সব সময় সবার রক জুটেছে তা নয়, তবে কলকাতার বাঙালির কপাল ভাল। কাজকারবার ছিল না, থাকলেও অন্য প্রদেশ থেকে কর্মের খোঁজে আসা লোকদের কাউকে পাচকের, তো কাউকে রিকশা টানার বা সদাগরি আপিস সামলে ব্যাঙ্কে টাকা জমিয়ে মিলিয়নেয়ার হওয়ার দায়িত্ব ভাগ করে দিয়ে সে সদর দরওয়াজা খুলে বাইরে প্রচণ্ড কলরবে পা ফেলেই দ্যাখে ‘ওম্মা, কী সুন্দর লাল সিমেন্টে কালো বর্ডার দেওয়া রোয়াক গো’! একটু না বসলেই নয়। ব্যস। নিজে তো গ্যাঁট হয়ে বসলই, বাপ-জ্যাঠা-মেসো-খুড়ো-ভাইপো-ভাগ্নে সব্বাইকে টেনে আনল সে চক্করে। ‘আপিসে গিয়ে কী হবে ভায়া, বরং জগাইকে বল ক’টা চা দিতে’। দিল্লি-মুম্বইয়ের মতো ছুটে গিয়ে আর এক জায়গায় খেপ মেরে আসে না দু’টো একস্ট্রা পয়সার জন্য। নো। কভি নেহি। ও সব পয়সার পিছনে ছোটা নোংরামো পাবেন না এখানে। উত্তর কলকাতার অনেক রোয়াকে সাদা-কালো পাথর বসিয়ে বানানো পারমানেন্ট পাশার ছক এখনও দেখা যাবে। আছে দাবার বোর্ডও। সেখানে আমরা মিলিত হই বিশ্বনাথন আনন্দ কী কী ভুল করার ফলে কোন কোন চ্যাম্পিয়নশিপ আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেল তার বিশ্লেষণের জন্য। আজকাল বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি হচ্ছে, তার রক থাকে না। এর পর ওবামা যদি কোনও দিন হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে নিশ্চিত পতনের দিকে গুটি গুটি এগোন, আমাদের কিন্তু দোষ দিতে পারবেন না, সে আগেই বলে রাখছি।
আজাদগড় কলোনি। ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’।
কলকাতার মতো উদ্বাস্তু কলোনি? নাহ্, হল না। পঞ্জাব টু প্যালেস্তাইন খুঁজে দেখুন। শ্যাওড়া-ঘেঁটু-আকন্দের ঝোপ, ডাঁশ-মশা-জোঁক-ভয়ানক বিষাক্ত সাপ, দিগন্তবিস্তৃত ধান আর পাটের এক হাঁটু কাদায় আঠালো-পাঁকালো জমি এবং কচুবন-জলা-পানাপুকুর যে দা, কোদাল, বঁটি, খুন্তি, শাবল হাতে কোনও দিন বিজয়গড়, আজাদগড়, লেনিনগড় হয়ে উঠবে, কোনও মিঞা ভেবেছিল? এক দল ভিটেমাটি ছাড়া মানুষ কেবল ‘কোনও মিউচুয়াল নাই’-এর ভরসায়, ‘কাউরে হালায় ছাড়ুম না’ মানসিকতার অবলম্বনে, ‘দেইখখা নিমু’ বলে দাঁতে দাঁত চিপে লড়ে বাঙালির মেরুদণ্ড যতটা সিধে করা সম্ভব, ততটা সিধে করে দিয়ে গেল। দিল্লিবাসী পঞ্জাবি পঞ্জাবিই। হাতে ধরে বাড়ি নিয়ে গিয়ে অ্যালবাম খুলে পুরনো ছবি দেখিয়ে বাপ-মা’র পাশে বসিয়ে দু-দণ্ড গল্প না শোনালে বুঝবার উপায় নেই যে, তার শিকড় কোথায় জালন্ধর না লাহৌর, করাচি না লন্ডন। কলোনি গজানোর পর থেকে বাঙালি আর বাঙাল আলাদা। ঢাকা আর চট্টগ্রাম আলাদা, মৈমনসিং আর সিলেট আলাদা। হেঁশেলে ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক রান্নায় আলাদা, বোঁদে নিখুঁতি দিয়ে মশকরায় আলাদা, জীবনে প্রথম চাকরিতে মাইনে পেয়ে ইস্টবেঙ্গলের ‘ষাইট ফুট লাম্বা’ ফ্ল্যাগ বানিয়ে পারিবারিক লাত্থি-গুতা হজম করেও ‘অ্যালাকায়’ হিরো হয়ে আলাদা। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও কখনও কোনও যুবক ‘মাসিমা মালপোয়া খামু’ বলে প্রেম নিবেদন করার ‘হাউসে’ বিনিদ্র রজনী যাপন করেনি। বিজয়গড়ে এক জন মাথাখারাপ মতো লোক রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। হাইট ছ’ফুটের একটু বেশিই হবে। এক দিন ওই রকমই লম্বা আর এক জন নিরীহ ভদ্রলোককে বাজারে কেনাকাটা করতে দেখে পাগলটা সোজা গিয়ে তাকে সপাটে একটা চড় কষিয়ে বলেছিল ‘লম্বা হওয়ার একটা সীমা থাকা দরকার’। লাল ফৌজ বা দাস ক্যাপিটাল সম্বন্ধে কিছু না জেনে জাস্ট আটা-রুটি সাপ্লাই দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে দাঁড় করানোর সময়, শত মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও নকশাল ছেলেটিকে চিলেকোঠায় শেল্টার দেওয়ার সময়, নিজের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া নিয়ে হ্যা হ্যা করে হাসার সময় বা দেশ কোথায় জিজ্ঞাসা করলে নারানগঞ্জে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের পিছনে মেঠো পথ আর সেই পথের বাঁকে বড় বটগাছ আর সেই বটগাছ পেরিয়ে ধু ধু মাঠের বর্ণনায় গোলকধাঁধায় আলোআঁধারিতে পথ হারানোর সময় আমাদের গালে অমনি সপাটে কেউ চড় মেরে ‘উদ্বাস্তু হওয়ার একটা সীমা আছে’ বললে হয়তো গল্পটা অন্য রকম হত। কে জানে।
ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে
তোমাকে বকব, ভীষণ বকব আড়ালে
হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে

বেজায় রিস্ক নিয়েও এ শহরে হর রোজ গড়ে দেড় কোটি নতুন কবির আমদানি কালচারালি ইনক্লাইন্ড বাঙালি সুনিশ্চিত করে তবে ছেড়েছে সোজা কথা নয়। ‘যে সকল মানবাত্মা নিতান্তই বাল্যকাল হইতে কবিত্বপ্রতিভায় চৌদিক মাৎ করিতেছেন, যাহারা ভাত ডালের তুলনায় খালাশিটোলার বাংলা অনেক বেশি টানিয়াও আশ্চর্যজনক সব কারণে বাঁচিয়া থাকেন বহুকাল, অন্যান্য প্রতিভাহীন অপগণ্ডদের কবিতা লিখিতে প্ররোচিত করেন এবং কী করিয়া জানি আমাদিগের গৃহবধূদের তুলনায় অধিকতর রূপসীদের ভুলাইয়া বিবাহ করিয়া এক প্রকার তঞ্চকতা করিয়াই বলা ভাল কফি হাউস নামক বেলেল্লাপনার খাজাঞ্চিখানায় পায়ের ওপর পা তুলিয়া বাপের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় দীর্ঘজীবন অতিবাহিত করেন, তাহারা এই শহরের কবি’। এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে একটা ষোলো কি আঠারো বছর বয়সী অবাঙালি কবিকে আলতো পিঠ চাপড়ে ‘আজ সারা দিন কেমন কাটল ভায়া’ জিজ্ঞেস করলে সে বলবে ‘এই একটা কোম্পানি বেচে লাভের টাকা ক’টা সুইস ব্যাঙ্কে ঢুকিয়ে সবে মাত্তর দু’টো কম্পিটিটিভ পোয়েটকে রাস্তায় ফিনিশ করে এলুম এ বার পাবলিশারের রগে পিস্তল ঠেকিয়ে বই ছাপাব।’ ওই বয়সী একটা বাঙালি ছোকরাকে ধরতে পারলে একই কথা শুধিয়ে দেখুন। মরা ভেটকি মাছের মতো আধবোজা চোখে জষ্ঠি মাসের দুপুরে গলায় মাফলার জড়াতে জড়াতে বলবে ‘মিনি বউদির কামরাঙা গাছ থেকে পলাশ ফুলের রবিকরণে কবোষ্ণ অন্ধকার বিগলিত কল্লেম।’ মেরে পাট করে দিতে হয়। কিন্তু পারি না। এ শহরে প্রতি দশ জনের সাড়ে ন’জন কবি। সকলের পকেটে ছোট ছোট কবিতার খাতা, এক আধজনকে বাদ দিলে, প্রত্যেকের বই বেরিয়েছে, নিজস্ব লিটিল ম্যাগাজিন আছে, শুনছি পাঠকও পেয়ে যান কেউ কেউ। আশ্চর্যের বিষয়, আমদানিকৃত কবিদের তো তেমন রফতানির ব্যবস্থা নেই। তা হলে তারা যায় কই? এরা কি আমাদের চার পাশেই ঘোরাফেরা করে নাকি রে বাবা! উঁহু, গন্ধটা খুব সন্দেহজনক।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.