রাষ্ট্রপতি হয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন রাইসিনা হিলসে গেলেন, অনেকেই ভেবেছিলেন প্রণববাবুর জীবনে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে চার-চাকাতেও পরিবর্তন আসবে।
দীর্ঘ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে প্রণববাবুর পছন্দের গাড়ি ছিল, অ্যাম্বাসাডর। কিন্তু রাষ্ট্রপতি প্রণববাবুকে এখন লিমুজিনে চড়তে হচ্ছে। সেটাই রীতি। সেটাই এ দেশে রাষ্ট্রপতির গাড়ি! কিন্তু তাই বলে অ্যাম্বাসাডর কিন্তু প্রণববাবুর জীবন থেকে একেবারে বেপাত্তা হয়ে যায়নি!
কী ভাবে? রাষ্ট্রপতির ক্যাভালকেডে দু’টি লিমুজিন থাকার কথা। তার একটি মাসখানেক যাবৎ বিকল! চলতে চলতে মাঝপথে স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়! খোদ জার্মানি থেকে প্রযুক্তিবিদ এসেও সারাতে পারেননি। আপাতত বিকল্প বা ‘ব্যাক আপ’ হিসেবে রাখা হয়েছে আদি অকৃত্রিম একটি অ্যাম্বাসাডর। তা-ও আবার পুরনো!
এতেই শেষ নয়। রাষ্ট্রপতির ক্যাভালকেডে যে অ্যাম্বুল্যান্স থাকার কথা, ইদানীং সেটিও বিকল। তাই প্রধানমন্ত্রী-সহ ভিভিআইপি-দের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপের (এসপিজি) কাছ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ধার করে আনা হয়েছে একটি অ্যাম্বুল্যান্স! |
খোদ রাষ্ট্রপতির কনভয়ের এমন দুর্দশা? প্রশ্ন করতে লজ্জায় পড়ে গেলেন রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের এক আমলা। বললেন, “এই তো সে দিন বীরভূমিতে রাজীব গাঁধীর সমাধিতে ফুল দিতে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি। সবেধন নীলমণি লিমুজিনটি যদি কোনও ভাবে সেদিন বিকল হত, তা হলে কী বিড়ম্বনাই না হতে পারত! লিমুজিন থেকে নেমে মাঝরাস্তায় অ্যাম্বাসাডরে উঠতে হত প্রণববাবুকে!” দেশের পয়লা নম্বর নাগরিকের জন্য পরিস্থিতিটা গরিমার নয়!
শুধু কি গরিমাই? রাষ্ট্রপতির কনভয়ের নিরাপত্তার দিকটাও এর সঙ্গে জড়িত। নিরাপত্তার কারণেই ক্যাভালকেডে রাষ্ট্রপতির জন্য একই ধরনের দু’টি গাড়ি থাকার কথা। যাতে ঠিক কোন গাড়িটিতে রাষ্ট্রপতি রয়েছেন, সেটা বোঝা না যায়। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় গাড়িটি ‘ব্যাক আপের’ও কাজ করে। কোনও কারণে একটি গাড়ি বিকল হলে যাতে অসুবিধা না হয়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। অথচ অত্যাধুনিক মার্সেডিজ বেঞ্জ এস ৬০০ সিরিজের লিমুজিনের সঙ্গে আদ্যিকালের অ্যাম্বাসাডর নিয়েই এখন কাজ চালাচ্ছে রাইসিনা এস্টেট।
বিশ্বের মোটামুটি সব দেশেই ‘প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেট লিমুজিন’ যথেষ্ট আগ্রহ ও আলোচনার বিষয়। যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে গাড়িটি চড়েন, সেটি ‘দ্য বিস্ট’ নামেই বেশি জনপ্রিয়। জেনারেল মোটরসের বানানো ক্যাডিলাক লিমুজিনটি আট ইঞ্চি পুরু ইস্পাতের পাতে তৈরি। যেমন শক্তপোক্ত, দেখতেও তেমনই দাপুটে। রাসায়নিক আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য গাড়ির মধ্যে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থাও রয়েছে। চিনা প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের জন্য আছে একটি হংকি (এইচ কিউ ই) ফোর ডোর লিমুজিন। যে সব দেশে অটোমোবাইল শিল্প দারুণ উন্নত, তারা সাধারণত নিজেদেরই কোনও সংস্থার গাড়িকে রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য বেছে নেয়। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে জাতীয় গরিমার চিহ্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন জেনারেল মোটরস, জাপানে টয়োটা, ব্রিটিশ রাজপরিবারের জন্য বেন্টলি...। আবার যে সব দেশের নিজের অটোমোবাইল শিল্প যেমন উন্নত নয়, তারা বিশ্বখ্যাত সংস্থাগুলি থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সঙ্গে মানানসই মডেলের গাড়ি বেছে নিয়ে থাকে।
ভারতে হিন্দুস্তান মোটরসের অ্যাম্বাসাডর দীর্ঘ দিন রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এখনও সরকারি কাজকর্মে অ্যাম্বাসাডর বহুল প্রচলিত। প্রণববাবু দিল্লিতে নিজে অ্যাম্বাসাডরই চড়তেন। তবে রাষ্ট্রপতির গাড়ি গত বেশ কয়েক বছর ধরেই বদলে গিয়েছে কালো লিমুজিনে। রাষ্ট্রপতির সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, অতীতে রাষ্ট্রপতির জন্য মার্সেডিজ বেঞ্জ-ডব্লিউ ১৪০ লিমুজিন ছিল। বছর দুয়েক আগে প্রতিভা পাটিলের জমানায় দু’টি নতুন গাড়ি কেনার ভাবনা শুরু হয়। অনেক বিচার-বিবেচনার পর স্থির হয়, দু’টি মার্সেডিজ এস ৬০০ পুলম্যান গার্ড কেনা হবে। বর্তমানে ৯০টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান মার্সেডিজ এস শ্রেণির গাড়ি ব্যবহার করে থাকেন। ২০০৯-এ বাজারে আসে মার্সেডিজ এস শ্রেণিরই নতুন সংস্করণ পুলম্যান গার্ড। এই গাড়ি শুধু প্রযুক্তিগত ভাবেই উন্নত নয়, নিরাপত্তার দিক থেকেও মজবুত। বুলেটপ্রুফ তো বটেই, গ্রেনেড আক্রমণও সহ্য করতে পারে এ গাড়ি। রাষ্ট্রপতি ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনা-কর্তা ও আমলাদের একটি প্রতিনিধিদল জার্মানির স্টুটগার্টে গিয়ে দু’টি নতুন পুলম্যান গার্ড লিমুজিনেরই বরাত দিয়ে আসেন। গাড়িটির অন্দরসাজ রাষ্ট্রপতির জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি (কাস্টমাইজড)। প্রায় ১২ কোটি টাকা দামে গাড়ি দু’টি যে দিন এল, রাইসিনা এস্টেটের গ্যারাজ সে দিন আহ্লাদে আটখানা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির জন্য এত দিনে দু’টো জুৎসই গাড়ি এসেছে।
তার পর দেড় বছরও যায়নি। একটি লিমুজিন বিকল! স্টুটগার্টের প্রযুক্তিবিদ এসেও ঠিক করতে পারেননি। মেরামতির কাজ এখনও চলছে। যদিও রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের তরফে বলা হচ্ছে, গাড়ি খারাপ হতেই পারে। সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়। জনৈক আমলার কথায়, “গত বছর ডাবলিন সফরে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের একটি ক্যাডিলাক লিমুজিনও আচমকা বিকল হয়ে পড়েছিল। বরাত জোরে সেটি ছিল ‘ব্যাক আপ কার’। বারাক ওবামা আর মিশেল ছিলেন অন্য গাড়িতে। তাই রক্ষে!”
অর্থাৎ? মোটের উপরে প্রণববাবুর নিরাপত্তা নিয়ে রাইসিনার কর্তারা উদ্বেগের কারণ আছে
বলে মনে করছেন না। সচিবালয়ের প্রেস সচিব বেণু রাজামণি বলেন, “একটি লিমুজিন ইদানীং বিকল ঠিকই। কিন্তু তাতে কোনও সমস্যা হচ্ছে না। ব্যাক আপ কার রয়েছে। সেটিও ভাল গাড়ি, বুলেটপ্রুফ অ্যাম্বাসাডর।” আর বিকল অ্যাম্বুল্যান্সের কী হবে? রাজামণির উত্তর, “বিষয়টি আমার জানা নেই।” |