কয়লা কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলে সরকারের উপর প্রবল চাপ তৈরি করতে এক দিকে যখন দল বেঁধে লোকসভা থেকে ইস্তফার প্রস্তাব পর্যন্ত বিবেচনা করছে বিজেপি, তখন শরিকদের পাশে নিয়ে সঙ্কট মোকাবিলায় নামলেন সনিয়া গাঁধী-মনমোহন সিংহ। জোটের সমন্বয় কমিটির বৈঠকের পর কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম দাবি করলেন, ইউপিএ ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। সরকার সব বিষয় নিয়ে সংসদে আলোচনায় প্রস্তুত। তবে বিরোধীদের কোনও অযৌক্তিক দাবি মানা সম্ভব নয়।
বিজেপি অবশ্য নাছোড়। কয়লা কেলেঙ্কারির অভিযোগে তারা এমনিতেই প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি করেছে। সেই চাপ আরও বাড়াতে দলের একাংশ এ-ও প্রস্তাব দিচ্ছে, লোকসভা থেকে বিজেপি সাংসদরা সবাই ইস্তফা দিয়ে দিন। আজ টু-জি কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) থেকে ওয়াক-আউট করে তারই জল মাপা শুরু করে দিলেন বিজেপি নেতারা। লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা স্বরাজ, যশবন্ত সিন্হার মতো নেতারা মনে করছেন, কয়লা কেলেঙ্কারিতে যখন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ তোলার সুযোগ এসেছে এবং লোকসভা ভোটেরও আর বেশি দেরি নেই, তখন সরকারের উপর এখনই প্রবল চাপ তৈরি করা হোক। বফর্স কেলেঙ্কারির সময় ঠিক এ ভাবেই প্রথমে জেপিসি থেকে বিরোধীরা ইস্তফা দিয়েছিলেন। তার পর ভোটের ঠিক আগে লোকসভা থেকেও বিরোধীরা ইস্তফা দেন। পরের লোকসভা নির্বাচনেই দুর্নীতি ইস্যুতে রাজীব গাঁধী পরাস্ত হন। বিজেপির এই নেতাদের বক্তব্য, রাজীব জমানায় বিরোধীরা অনেক দুর্বল ছিলেন। কিন্তু এখন সংখ্যার নিরিখে বিরোধীরা অনেক বেশি শক্তিশালী। ফলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাঁরা যদি সরকারকে চরম ধাক্কা দিতে পারেন, তা হলে পরের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে দিল্লির মসনদ থেকে উৎখাত করা সম্ভব হবে।
বিজেপি-র এমন কৌশলের মোকাবিলায় এখন দ্বিমুখী রণনীতি নিচ্ছেন সনিয়া-মনমোহন। তাঁদের লক্ষ্য এক, ইউপিএ-র ঘর গোছানো। দুই, সংসদে বিজেপিকে একঘরে করা। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের জমানায় গত তিন বছরে সমন্বয় কমিটি গঠন নিয়ে যে কংগ্রেস নানা টালবাহানা করেছে, তারাই এখন শরিকদের পাশে পেতে কয়েক কদম এগিয়ে এসেছে। এমনকী, আজ সমন্বয় কমিটির বৈঠকের আগে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একপ্রস্ত কথা বলে আসেন প্রধানমন্ত্রী। কংগ্রেস নেতাদের দাবি, সনিয়া-মনমোহনের উপস্থিতিতে বৈঠক অনেকটাই খোলামেলা হয়েছে। শরদ পওয়ার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শরিক নেতারা বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের মতামত, আপত্তি বা পরামর্শ জানালেও তা হয়েছে একেবারে সৌহার্দ্যপূর্ণ বাতাবরণে। আগামী ৩ সেপ্টেম্বর কমিটির পরবর্তী বৈঠক। এর পাশাপাশি বিরোধী জোটের শরিক, বাম নেতৃত্ব এবং অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি দলগুলিকে বোঝানোর চেষ্টাও শুরু করে দিয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। তাঁরা মনে করছেন, এতে কিছুটা কাজও দিয়েছে। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফা চেয়ে বিজেপি সংসদ অচল করলেও তাতে সংযুক্ত জনতা দল, বিজু জনতা
দল অথবা বামেরা সায় দিচ্ছেন না। বরং সংসদের অচলাবস্থা কাটানোর দাবি তুলছেন বামেরা। একই দাবি জানাচ্ছে বিজেডি।
তবে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় সেটাই দেখার। পওয়ার বা মমতা কংগ্রেসকে কতটা সহযোগিতা করবেন, সেটাও ক্রমশ প্রকাশ্য। অন্য দিকে, রণকৌশল নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে বিজেপি-র মধ্যেও। দলের এক নেতার কথায়, আডবাণী থেকে যশবন্ত সিন্হার মতো নেতারা লোকসভা থেকে একজোটে ইস্তফা নিয়ে তৎপরতা দেখাচ্ছেন নিজ স্বার্থে। বিজেপির মধ্যেই এখন নেতৃত্বের সঙ্কট তীব্র হচ্ছে। এ বছরের শেষ নাগাদ বিজেপিতে দু’টি বড় সিদ্ধান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এক, সভাপতি পদে নিতিন গডকড়ীর মেয়াদ বৃদ্ধি। দুই, এ বছরের শেষে গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনের পরেই স্থির হবে, দলের নিচু তলার দাবি মেনে নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হবে কি হবে না। ফলে দলের শীর্ষ থেকে দ্বিতীয় প্রজন্মের যে নেতারা মনে করছেন, তাঁদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে না, তাঁরাই এই সময়টাকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাতে চাইছেন। তাঁরা চাইছেন, একযোগে ইস্তফা দিয়ে বিরোধীশূন্য সংসদের পরিস্থিতি তৈরি করা হোক। সে ক্ষেত্রে নজিরবহীন বিড়ম্বনায় সরকার হয়তো ভোটে যেতেও পারে, এমন একটা ক্ষীণ আশা করছেন এই নেতারা।
যদিও বিজেপি তো বটেই, এনডিএ-র জোট শরিকদের একাংশের মধ্যেও এ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। নীতীশ কুমার এখনই ভোটে যাওয়ার পক্ষপাতী নন। আবার, মায়াবতী-মুলায়মরাও নন। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ মনে করছেন, সংসদে এর আগেও নানা বিতর্কিত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কমনওয়েলথ থেকে টু-জি সব নিয়ে অনেক তদন্ত করিয়েছেন। কিন্তু এ রাজা, দয়ানিধি মারানের মতো ইউপিএ-র শরিক দলের নেতা ছাড়া কাউকে ইস্তফা দিতে হয়নি। যখনই অভিযোগ মনমোহন, চিদম্বরম বা শীলা দীক্ষিতের মতো কংগ্রেস নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠে, তখনই চুপ করে বসে থাকেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। কাজেই ভোটের আগে কংগ্রেসকে আর রেয়াত করার কোনও অর্থ হয় না। সে কারণেই চরম পদক্ষেপ করার আগে আজ জেপিসি থেকে যশোবন্ত সিংহ, যশবন্ত সিন্হা, রবিশঙ্কর প্রসাদ, গোপীনাথ মুণ্ডের মতো নেতারা ওয়াক-আউট করেন। মনমোহন-চিদম্বরমকে কমিটিতে জেরার দাবি তুলেছিলেন বিজেপি নেতারা। মণীশ তিওয়ারি যখন ‘ক্যাঙ্গারু-কোর্ট’ বলে বিরোধী নেতাদের ব্যঙ্গ করেন, তখনই সেই অছিলায় তাঁরা ওয়াক-আউট করেন। দলীয় সূত্রের মতে, এই পরিকল্পনা আগেই ছিল বিজেপির। লোকসভা তথা সমস্ত সংসদীয় কমিটি থেকে সাংসদদের ইস্তফার সম্ভাবনা নিয়ে দলে চর্চা তো চলবেই, তবে কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়া চরমে তোলাটাই এখন অগ্রাধিকার। |