ঘটনা ১: বিজেপি চাইছিল, কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে তারা যে প্রধানমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি করেছে, তাতে তৃণমূলও সুর মেলাক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এই আর্জিই জানান বিজেপি নেতারা। কিন্তু রাজি হননি মমতা।
ঘটনা ২: বিজেপি এবং সিপিএম আজ দাবি করে, টুজি বিতর্কে গঠিত যৌথ সংসদীয় কমিটির সামনে প্রধানমন্ত্রীকে ডাকা হোক। কিন্তু মমতার নির্দেশে ওই কমিটির সদস্য তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের দাবিতে সায় দেননি। তৃণমূলের বক্তব্য, যৌথ সংসদীয় কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ডাকা যায় না। এতে ভুল দৃষ্টান্ত তৈরি হবে।
ঘটনা ৩: ইউপিএ-র সমন্বয় কমিটির বৈঠকের আগে মমতার সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। অনুরোধ করেন, মমতা যেন ২৪ তারিখ পর্যন্ত থাকেন দিল্লিতে। মুখ্যমন্ত্রী সেই অনুরোধ মেনে নিয়েছেন।
এই তিন ঘটনা যদি রাষ্ট্রপতি ভোটের আগেকার রুক্ষ আবহাওয়া পার হয়ে কংগ্রেস কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও তৃণমূলের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্কের বার্তা বহন করে, তা হলে এর বিপরীতে রয়েছে দলীয় ইস্যুগুলি নিয়ে মমতার অনড় থাকার সিদ্ধান্ত। তৃণমূল নেতৃত্ব ঠিক করেছেন, সরকারে থেকেই নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে কেন্দ্রের উপরে চাপ বাড়াবেন তাঁরা। সে জন্য কখনও সংসদের ভিতরে, কখনও বাইরে মুখ খুলবে তৃণমূল। নিজেদের দাবিতে ধর্না-আন্দোলনের দিনক্ষণও ঠিক করে ফেলা হয়েছে। |
এ সব সত্ত্বেও সামগ্রিক ভাবে মমতা কিন্তু এ বারে ইতিবাচক বার্তাই দিয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্বকে। ইউপিএ-র সমন্বয় কমিটির প্রথম বৈঠকে হাজির ছিলেন না মমতা। প্রশ্ন উঠেছিল তাই নিয়ে। এ বারে দ্বিতীয় বৈঠকে এসে কিন্তু বার্তা দিলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং সনিয়া গাঁধীর সঙ্গেই আছেন।
পরিবর্তে কংগ্রেস তথা কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বও মমতাকে আগের মতোই গুরুত্ব দিচ্ছেন। সে জন্যই প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেছেন। সেখানে মমতা জানিয়েছেন, তিনি যে সব দাবিতে সরব হয়েছেন তা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় নয়। সম্পূর্ণ ভাবে রাজ্যের বিষয়। উল্টো দিকে প্রধানমন্ত্রীও তাঁকে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। সেই সূত্রেই আগামিকাল নতুন অর্থমন্ত্রী চিদম্বরমের সঙ্গে বৈঠক করার কথা মমতার। এবং আবার বসবেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে এই প্রথম কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে নিজের দাবি নিয়ে আলোচনায় বসবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে তিন বছরের জন্য রাজ্যের সুদ-আসল মুকুবের প্রসঙ্গটিও উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে।
মমতার অবস্থান স্পষ্ট। কেন্দ্রে কংগ্রেস এই মুহূর্তে যথেষ্ট দুর্বল। অন্য দিকে, অকাল লোকসভা ভোট হলে তার জন্য তৃণমূল কিন্তু প্রস্তুত। অর্থাৎ, দর কষাকষির ক্ষেত্রে মমতা এখন যথেষ্ট ভাল জায়গায়। তবু এখনই ইউপিএ সরকারের মধ্যে অচলাবস্থা তৈরি করা তাঁর লক্ষ্য নয়। তাই এ বার সংসদের সেন্ট্রাল হলে যাচ্ছেন না মমতা। জাতীয় রাজনীতি নিয়ে কোনও মন্তব্য এখনও তাঁর মুখে শোনা যায়নি। সিএজি রিপোর্টে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কেও বলেছেন, “দুর্নীতির প্রশ্নে তৃণমূল যে কোনও আপস করে না, তা সকলেই জানেন। সংসদে যদি বিষয়টি নিয়ে কোনও আলোচনা হয় তখন দলীয় মতামত রাখা হবে।” এ কারণেই গত কাল বিজেপি-র দুই নেতা রাজীবপ্রতাপ রুডি ও শাহনওয়াজ হুসেনের সঙ্গে মমতার আচমকা সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকারটি ঘিরে তৈরি হওয়া যাবতীয় জল্পনাও তৃণমূল নেতৃত্ব উড়িয়ে দিয়েছেন। রেলমন্ত্রী মুকুল রায় বলেন, “একেই বলে গল্পের গরুর গাছে ওঠা। মমতা ইউপিএ-তেই আছেন। বিজেপি-র সঙ্গে তৃণমূলের সমঝোতার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।” সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও আজ বলেছেন, “আমরা ইউপিএ-তেই আছি। ইউপিএ থেকে চলে যাওয়ার কোনও প্রশ্ন উঠছে না।” তৃণমূল সূত্র বলছে, পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু ভোট প্রায় ২৭ শতাংশ। গত কয়েক বছর ধরে মমতার একাধিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু সমাজের কাছে নিজের জনভিত্তি বাড়িয়ে তুলতে সফল হয়েছেন। এর আগে এক বার এনডিএ-তে গিয়ে মমতা দেখেছেন, সংখ্যালঘু ভোটের ক্ষেত্রে কী রকম প্রভাব পড়ে। তাই নতুন করে আর বেলতলায় যেতে চান না তৃণমূল নেতৃত্ব। তবে ইউপিএ-র ভিতরে থাকলেও দুর্নীতি এবং রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ মনোভাব নিয়ে ঘরে-বাইরে সরব হওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে তৃণমূল। আজ মমতার সঙ্গে তৃণমূল সাংসদদের ঘরোয়া বৈঠকে ঠিক হয়েছে, ২৭ অগস্ট সংসদের সামনে সারের দাম বৃদ্ধি, পশ্চিমবঙ্গের প্রতি আর্থিক বঞ্চনা থেকে শুরু করে বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির প্রতিবাদ সব কিছু নিয়েই ধর্নায় বসতে চলেছে দল। পশ্চিমবঙ্গের প্রতি আর্থিক বঞ্চনার বিষয়টি নিয়ে সংসদের ভিতরেও সরব হবে তৃণমূল। ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, শুধু খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নিই নয়, তিস্তা চুক্তি-সহ বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মুখ বুজে মেনে নেবেন না তৃণমূল নেতৃত্ব। এ দিন ইউপিএ-র বৈঠকেও বিষয়গুলি নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা। দলের বক্তব্য, নীতির প্রশ্নে সরকারের বিরোধিতা করতে পিছপা হবে না দল। তবে কঠিন সময়ে বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকারকে ব্রিবত করবেন না তাঁরা। |