মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে ঈদকে সর্বজনীন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাতে সিপিএম চাপে পড়ে গিয়েছে। সিপিএম নেতারা প্রকারান্তরে স্বীকার করছেন, রমজান ও ঈদের মতো উৎসবকে যে ভাবে মমতা শারদীয়ার মতো গণ-উৎসবের চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাতে মুসলিম সমাজের একাংশ যথেষ্ট খুশি। ভোটেও এর প্রভাব পড়বে বলেই তাঁদের ধারণা।
এ বারের গণ-ঈদ পালিত হয়েছে খোদ মমতার নির্দেশেই। কেন্ত্রীয় মন্ত্রী সুলতান আহমেদ এ কথা জানিয়ে বলেন, “আমরা ঈদকে কেবল মুসলিমদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছি। এতে রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূল লাভবান হবে।” বিষয়টি স্বীকার করছেন সিপিএমের একাধিক মুসলিম নেতাও। দলের রাজ্য কমিটির সদস্য রেজ্জাক মোল্লা বলেন, “ঈদের প্রচার এ বার অনেক বেশি। সেটা ভাল লাগছে।” ঈদ নিয়ে এই প্রচারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে প্রবল সমালোচনা করলেও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম স্বীকার করছেন, “যে ভাবে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ঈদের শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে, তাতে একটা উৎসবের পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়েছে।”
এমনিতে যদিও সিপিএম মনে করে, প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও এক বছরে মমতা মুসলিম উন্নয়নে যথেষ্ট কাজ করেননি। ঈদের আগের দিনই সাংবাদিক বৈঠক ডেকে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এই অভিযোগ করেছেন। এখন মহম্মদ সেলিমের অভিযোগ, “বিজেপি বা শিবসেনা যে ভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে ভোট পাওয়ার লক্ষ্যে, ঠিক সেই ভাবে মমতা ঈদ পালন করার চেষ্টা করছেন।” সিপিএম নেতারা মানুষকে বোঝাতে চাইছেন, মমতা মুসলিমদের প্রকৃত উন্নয়ন না করে শুধু উৎসব পালন করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মানুষ কী দেখছেন? তাঁদের চোখে গুরুত্ব পাচ্ছে এটাই যে, মুখ্যমন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে তৃণমূলের সাংসদ-বিধায়করা গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র ব্যানার-হোর্ডিংয়ে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। মমতা-সহ তৃণমূলের নেতারা যে ভাবে ঈদকে সর্বজনীন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন, বাম জমানায় কখনও তা হয়নি। কমিউনিস্টরা ধর্মাচরণে বিশ্বাস করেন না। সে কারণেই বাম জমানায় সিপিএম নেতারা কোনও দুর্গাপুজোর সঙ্গেও সরাসরি যুক্ত হতে পারতেন না। জন-সংযোগের জন্য তাঁরা শারদ উৎসবকে ব্যবহার করতেন। এ বিষয়ে দলেরও অনুমোদন ছিল। সিপিএমের মুসলিম নেতারা নিজেদের মধ্যে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করলেও তাকে কখনও সর্বজনীন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেননি। স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের চোখে দুই জমানার পার্থক্য ধরা পড়ছে।
এক্রামূল বারির মতো আইনজীবী বা মোয়াজ্জম হোসেনের মতো চিকিৎসকরাও মনে করছেন, ঈদকে এই ভাবে শারদীয়ার মতো চেহারা দিয়ে মমতা রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হলেন। হোসেনের মতে, “এ বার কলকাতার হিন্দু-প্রধান এলাকায় গেলেও বোঝা গিয়েছে ঈদ উৎসব পালিত হচ্ছে।” আদতে বর্ধমানের রায়নার বাসিন্দা এক্রামূলের কথায়, “গ্রামে ঈদের উৎসবে এ বার বড় বড় গেট হয়েছে। যা অতীতে হয়নি।”
এই পরিস্থিতির মোকাবিলা সিপিএম কী ভাবে করবে? রেজ্জাকের মতে, “মুসলিমদের আত্মপরিচয়ের বিষয়টিতে দলকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।” রেজ্জাক এ বার স্ত্রীকে নিয়ে হজ যাত্রার তোড়জোড় করছেন। তারাপীঠে পুজো দিয়ে দলে ভর্ৎসিত হয়েছিলেন প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী। সে কথা মাথায় রেখেও রেজ্জাক বলেন, “আমি মুসলিম। ঈদ করি। হজে যাচ্ছি। এতে পার্টির আপত্তির কী আছে?” ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেছেন, “যে ভাবে মমতা-সহ তৃণমূলের নেতারা রমজান ও ঈদের মধ্য দিয়ে জন-সংযোগ করছে, তা আটকাতে গেলে দলকেও নতুন করে ভাবতে হবে।”
রেজ্জাকের মতের সমর্থক আরও অনেকেই। দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের উপস্থিতিতে ১৪-১৬ সেপ্টেম্বর আলিমুদ্দিনে দলের রাজ্য কমিটির বর্ধিত বৈঠক বসছে। পঞ্চায়েত ভোটে সংখ্যালঘু সমর্থন ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে বৈঠকে আলোচনা হবে। মমতা সংখ্যালঘুদের কাছে নিজেকে জনপ্রিয় করে তোলার যে নীতি নিয়েছেন, তাকে প্রতিহত করার নীতিও নির্ধারণ করা হবে। |