|
|
|
|
অটো-ফরমান ব্যর্থ, মন্ত্রীর ভরসা এখন ইউনিয়ন |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ‘ফরমান’ ঘোষণা আর তাকে কাজে পরিণত করার মধ্যে ফারাক যে বিস্তর, অটো-রাজে লাগাম দিতে গিয়ে স্বয়ং পরিবহণমন্ত্রী তা টের পেলেন। যার জেরে এ বার পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইউনিয়নের নেতাদের পথে নামতে অনুরোধ করলেন তিনি। অটোচালকদের নিয়মে বাঁধতে রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র গত এপ্রিলে ঘোষণা করেছিলেন, কোনও অটোয় চার জনের বেশি যাত্রী তোলা যাবে না। কিন্তু সেটা স্রেফ ‘মুখের কথা’ হয়েই থেকে যায়, অধিকাংশ চালক মন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করেননি। অবস্থা না-বদলানোয় অটো সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও গত জুনে মন্ত্রীর কাছে একই সুপারিশ জমা দেয়। মদনবাবু তখন আশ্বাস দিয়েছিলেন, রাজ্য প্রশাসন কমিটির সুপারিশ কার্যকর করবে।
সেই রিপোর্ট পেশের পরে দু’মাস পেরিয়ে গিয়েছে। এবং মঙ্গলবার পুলিশ-প্রশাসন ও অটো ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসে পরিবহণমন্ত্রীর কাছে যে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, তা হল: কমিটির সুপারিশ তো বটেই, প্রায় পাঁচ মাস আগে ঘোষিত ফরমানের কোনও অংশই বাস্তবায়িত করা যায়নি। ফলে অটোকে শৃঙ্খলায় বাঁধতে মদনবাবুকে এ দিন ফের একগুচ্ছ ‘নির্দেশ’ ঘোষণা করতে হয়েছে।আগের বেঁধে দেওয়া নিয়মের কী দশা, এ দিন রুট-প্রসঙ্গে আলোচনাতেই তার একটা নমুনা মিলেছে। কী রকম?
এপ্রিলের বৈঠকে অটো ইউনিয়নগুলোকে মন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোনও অটো নির্দিষ্ট রুট ভাঙতে পারবে না। অর্থাৎ ‘কাটা রুট’ বরদাস্ত করা হবে না। অন্যথা হলে পুলিশ জরিমানা করবে বলে সে দিন হুঁশিয়ারিও দেন তিনি। অথচ এ দিন মন্ত্রী দেখলেন, আগের পরিস্থিতিই বহাল। তাঁকে বলতে হল, “অনেক রুটে অভিযোগ আসছে, নির্দিষ্ট গন্তব্যে না-গিয়ে চালকেরা অর্ধেক পথ যাচ্ছেন। সেখানে নতুন করে যাত্রী তুলছেন।” এর সুরাহা কী?
মন্ত্রীর ঘোষণা, “পুলিশকে বলা হয়েছে এমন দেখলেই জরিমানা করতে। সঙ্গে সঙ্গে যদি না-ও পারা যায়, পরে নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে।” |
|
কিন্তু কোনও অটোকে জরিমানা করা যে কতটা ঝক্কির, ট্র্যাফিক সার্জেন্টরা তা বিলক্ষণ জানেন। যেমন উত্তর কলকাতার আরবিন্দ সরণিতে ডিউটি করা এক সার্জেন্টের মন্তব্য, “অটোকে কিছু করলেই তো অশান্তি! পিছনে ইউনিয়ন আছে। রাস্তা অবরোধ পর্যন্ত হয়ে যায়। উপরওয়ালার কাছে জবাবদিহি করতে হয়।” অগত্যা ‘অশান্তি’ এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করছেন ওঁদের অনেকে। ‘অনিয়ম’ দেখেও দেখছেন না।
এ অবস্থায় অটো-রাজ রুখতে রাজ্য সরকার কেন কড়া হচ্ছে না, সে প্রশ্নটা বড় হয়ে উঠছে। যার উত্তরে পরিবহণমন্ত্রী বলছেন, “চালকদের বিরুদ্ধে কড়া হওয়ার পথে আমাদের প্রধান বাধা কেন্দ্রের মোটর ভেহিক্লস অ্যাক্ট। আমরা শুধু গাড়ির পারমিট বাতিল করতে পারি। পুলিশকে তা-ই করতে বলা হয়েছে। দোষী প্রমাণিত হলে চালককে ছ’মাস বসিয়ে দেওয়া হবে।” ঠিক কী অপরাধ করলে চালককে ছ’মাস বসিয়ে রাখা হবে, সে সম্পর্কে অবশ্য মন্ত্রী এ দিন স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি। পাশাপাশি তাঁর নির্দেশ প্রশাসন ঠিকঠাক মানতে পারল না কেন, তারও জবাব দেননি। তবে যাত্রীদের ‘প্রতিবাদে মুখর’ হতে আহ্বান জানিয়েছেন। আমজনতার প্রতি মদনবাবুর আবেদন, “অটোয় ডান দিকে যাত্রী তোলা হলে প্রতিবাদ করুন।” |
নিয়ম-নামা |
৮ এপ্রিল, ২০১২ |
১৬ জুন, ২০১২ |
২১ অগস্ট, ২০১২ |
• চারের বেশি যাত্রী তোলা যাবে না।
• অবরোধ-ধর্মঘট নিষিদ্ধ।
• ভাড়াবৃদ্ধি নয়, বিজ্ঞাপন দিয়ে আয়।
• পারমিট-রুট নির্ধারণে কমিটি।
• চালকদের লাইসেন্স আবশ্যিক।
• চালকদের ইউনিফর্ম।
• হাই-সিকিওরিটি নম্বরপ্লেট।
• রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁষে চলতে হবে। |
• চারের বেশি যাত্রী নয়।
• মহানগরকে ছ’টি অটো-এলাকায় ভাগ।
• প্রতি ভাগে অটোর স্বতন্ত্র রং।
• এক এলাকার অটো শুধু সেখানেই।
• সমান ভাড়া,
প্রথম ৩ কিমি’তে ৫ টাকা।
• কোনও রুট ৭ কিমি-র বেশি নয়।
• নতুন রুট বানানো যাবে না।
• জ্বালানি গ্যাসের ব্যবস্থা দ্রুত। |
• চার জনের বেশি যাত্রী তোলা মানা।
• গান বাজবে না, ঝিকিমিকি আলো নয়।
• অটোয় লেখা চাই হেল্পলাইন নম্বর ১০৭৩।
• ইউনিয়নের তথ্য দেখে
চালককে আই-কার্ড।
• নিয়ম লঙ্ঘনে পারমিট বাজেয়াপ্ত।
• দোষী চালক ছ’মাস বসে থাকবেন।
• মুনাফার লক্ষ্যে রুট ভাঙা যাবে না।
• চালক-প্রশিক্ষণ শিবির, কৃতীদের ইনাম। |
|
যদিও এক শ্রেণির অটোচালক বা ট্যাক্সিচালকের ‘স্বেচ্ছাচারিতা’র প্রতিবাদ করলে কী ফল হতে পারে, তাঁর একটা আন্দাজ এ দিন হাতে-নাতে পেয়ে গিয়েছেন হাওড়ার প্রীতম চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মাকেও রেয়াত করা হয়নি।
ফলে প্রশ্ন কিছু থেকেই যাচ্ছে। উল্লেখ্য, সোমবারই পরিবহণমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, কামারহাটি থেকে আসার সময়ে তিনি নিজের চোখে দেখেছেন, অটোগুলো কী ভাবে বাড়তি যাত্রী তুলে নির্বিবাদে যাতায়াত করছে। উপরন্তু দিনের কিছু কিছু সময়ে কোনও কোনও রুটের অটো যে যাত্রী ফিরিয়ে দিচ্ছে, মন্ত্রী তা-ও জানেন। অর্থাৎ অটো নিয়ন্ত্রণে গত ক’মাস যাবৎ তিনি পরের পর ফরমান জারি করলেও চালকদের একাংশ যে তাতে কান দিচ্ছেন না, মন্ত্রীর কথায় তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। এবং এই মুহূর্তে মন্ত্রীর উপলব্ধি: প্রশাসনের চাপে অটোকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা যাবে না।
তা হলে উপায়?
এমতাবস্থায় মন্ত্রী চাইছেন অটো ইউনিয়নকে নিয়ে পথে নামতে। “অটোকে শৃঙ্খলিত করতে হলে ইউনিয়নকে রাস্তায় নামতে হবে। সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে ন’টা পর্যন্ত যাত্রীদের বেশি করে হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে। আমরা ইউনিয়নের নেতাদের ওই সময়ে স্ট্যান্ডে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করেছি।” বলেন তিনি। নেতারা কী বলছেন?
এ দিন বৈঠকের পরে তৃণমূল-প্রভাবিত অটো ইউনিয়নের নেতা প্রদীপ সাহা জানিয়েছেন, তাঁরা সব সিদ্ধান্তে সরকারের পাশে আছেন। সিটু-সমর্থিত কলকাতা অটোরিকশা অপারেটর্স ইউনিয়নের নেতা অজিত চৌধুরীও বলেন, “সহযোগিতায় আমরা তৈরি। সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করুক।” |
|
এক ট্র্যাফিক সার্জেন্টও বলেন, “মন্ত্রী ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে রাস্তায় নামলে তো খুব ভাল! ওঁরা নিজের চোখেই দেখবেন, কেন আমরা ফাইন করতে ভয় পাই।” তবে ইউনিয়ন ‘পাশে থাকলেও’ অটোর ভাড়া না-বাড়লে বাড়তি যাত্রী তোলা থেকে চালকেরা বিরত হবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকছেই। যা নিরসনের জোরালো ইঙ্গিত এখনও নেই। |
|
|
|
|
|