আদালতের রায়ে সিঙ্গুর ফের সরগরম। সরকার চাল আর টাকা বরাদ্দ করে পরিস্থিতি
সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেটা সমাধান হতে পারে না। লিখছেন
বোলান গঙ্গোপাধ্যায় |
কোনও রাজনৈতিক দলের কাছে মাথা না মুড়িয়েই জমি ও জীবিকা হারানোর নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকে সিঙ্গুরের ভূমিজীবী মানুষ প্রতিবাদে নেমেছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের সেই স্বকীয়তা খুব বেশি দিন বজায় থাকেনি। তখনকার বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস এসে আন্দোলন পরিচালনার ভার নেয়। ফলত কৃষকের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ দলীয় রাজনীতির ফায়দা তোলার হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’ ক্রমশ পিছু হটতে থাকে। সিঙ্গুরের আন্দোলন ধর্মতলার ধর্নামঞ্চে কেন্দ্রীভূত হয়। সেখানে তৈরি হয় বুদ্ধিজীবী, মধ্যবিত্ত, জমির সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং তৃণমূলের নীতিতে আস্থাবান মানুষ নিয়ে ‘জীবন ও জীবিকা রক্ষা কমিটি’।
আন্দোলনের ধারার মধ্যে এখানেই নিহিত হয়েছিল আত্মঘাতের বীজ। আন্দোলন সেই দিন থেকেই দিক্বদল করতে থাকে। সিদ্ধান্তে দলীয় রাজনীতির স্বার্থ রক্ষা করতে যতটা তৎপরতা দেখা যায়, কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় ততখানি আন্তরিকতা প্রকাশ পায়নি। যখন কলকাতায় দাবি উঠছে যে ‘ওই জমি-ই চাই’, তখন সিঙ্গুরের জমি তার চাষযোগ্যতা হারিয়ে হয়ে উঠছে শিল্পের জমি। কাঁকর, বালি, ফ্লাই-অ্যাশের সাহায্যে তার রূপান্তর ঘটছে। মানুষ-সমান কংক্রিটের পাঁচিল উঠছে। সিঙ্গুরের মানুষ তখনও ভেবেছিলেন যে, রাজ্যে সরকার বদল হলেই ওই পাঁচিল ভেঙে পড়বে, জমি তাঁরা ফেরত পাবেন।
সিঙ্গুরের এই আন্দোলনকে অন্যতম হাতিয়ার করে রাজ্যে সরকার বদল হয়ে গেল। সিঙ্গুরের কৃষকের জমি ফেরত দিতে যে রাজ্য সরকার আন্তরিক, সেই প্রমাণ দিতে ‘বিল’ এসেছে। কিন্তু তাতেও আছে বিস্তর ফাঁক-ফোকর। কৃষকের ভাগ্যে কিছুই এখনও জোটেনি। আদৌ জুটবে কি না, সে প্রশ্নও অপ্রাসঙ্গিক নয়। |
ধরা যাক সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকার জয়ী হল, জমি সরকারের হাতে ফেরত এল। তা হলেও কি ওই জমিতে কৃষক অধিকার ফিরে পাবেন? তা হলেও ওই জমি বিশ বাঁও জলে কারণ, যে জমি যে কৃষকের, সেই জমি তো আর ফেরত দেওয়া যাবে না। তার অনেকটাই চলে গেছে কারখানার মূল কাঠামোর মধ্যে। এক কৃষকের জমি অন্য কৃষককে ফেরত দিলে আবার কোর্ট-কাছারি। তার পরও প্রশ্ন থেকে যায়, ফেরত পাওয়া জমিতে আদৌ চাষবাস করা সম্ভব কি না। অনেক কৃষকই বলেছেন ‘দোকান দিতে হবে’। আজকে এ কথা বলাই যায় যে, যদি ‘ওই বিশেষ জমি’র দাবিই প্রধান ছিল, তা হলে জমি দখল নেবার আগে জান-কবুল লড়াই করা প্রয়োজন ছিল। সেই লড়াইয়ের জন্য সিঙ্গুরের ভূমিজীবী মানুষ প্রস্তুত ছিলেন না, এমনও নয়। কিন্তু নেতৃত্ব সেই লড়াইয়ে শামিল হয়নি। ধর্মতলার মঞ্চ যত গর্জেছিল, তত বর্ষায়নি।
কী হলে কী হত, সে প্রশ্ন আজ আর তুলে লাভ নেই। সিঙ্গুরে এখন ঘরে ঘরে অন্নের হাহাকার, কাজের হাহাকার। খেতমজুর পরিবারগুলির এমন কোনও বিশেষ ধরনের শিক্ষা নেই বা পারদর্শিতা নেই যে তাঁরা অন্যত্র কাজ করবেন। ফলত মাসের মধ্যে অধিকাংশ দিনই এখন কোনও কাজ নেই বেশির ভাগ খেতমজুর পরিবারের। এই কর্মহীনতা এবং আলস্য সিঙ্গুরের নিত্যসঙ্গী। দিনের বেলায় ক্লাবঘরগুলিতে জোয়ান ছেলেদের ভিড়। আপন মনে একটা টিভি চলে। টিভি দেখাতেও কারও মন নেই। অনেকেই নানা নেশায় শিকার হয়ে পড়ছেন।
বহুবার সিঙ্গুরের কৃষকের কাছে বিকল্প জমির কথা শুনেছি। এই অচলাবস্থা থেকে বেরোতে মনে হয় বিকল্প জমিই একমাত্র উপায়। হুগলি জেলারই অন্যত্র এই জমির খোঁজ যদি মেলে, সেটাই হবে কৃষক-সমাজ এবং কৃষিকে বাঁচানোর পথ।
হাইকোর্টের রায় বিপক্ষে যাবার পর রাজ্য সরকার ‘কী করা যায়’ সেই প্রশ্ন সামনে রেখে একটি সভার আয়োজন করেছিল। সেই সভায় যত বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত জমির সঙ্গে সম্পর্কহীন মানুষের উপস্থিতি ছিল, তুলনায় কৃষিজীবী মানুষ নগণ্য। সেখানে সিঙ্গুরের জন্য ‘ফান্ড’ তৈরির প্রস্তাব উঠেছে। ‘বিকল্প জমি’র কথা উঠেছে বলে জানি না।
এখন সম্ভবত মেনে নেওয়ার সময় এসেছে যে, ওই জমি পেলেও কৃষির কোনও লাভ হবে না। সরকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বলেই তাকেও মাঝে মাঝে ‘ইগো’ বিসর্জন দিতে হয়। অন্তত ইতিহাস সেই শিক্ষাই দেয়। |