আটচল্লিশ বৎসর এবং দুই সপ্তাহ, ৬ অগস্ট ১৯৬৪ থেকে ২০ অগস্ট ২০১২ প্রায় অর্ধ শতক। ১৯৬৪ সালে মায়ানমার তথা বর্মা দেশটির প্রচারমাধ্যমের উপর যে তীব্র নিয়ন্ত্রণ জারি করিয়াছিলেন সামরিক কর্তারা, এত দিন পর সেই নিয়ন্ত্রণ আইন উঠাইয়া দিয়া ঐতিহাসিক পদক্ষেপ করিলেন প্রেসিডেন্ট থিন সেইন-এর সংস্কারবাদী সরকার। এত দিন সে দেশের সংবাদমাধ্যমের যে কোনও লেখা লিখিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সেন্সর বোর্ড-এর নিকট জমা দিতে হইত, এবং সবুজ সংকেত মিলিবার পরই কেবল তাহা প্রকাশিত হইত। এখানেই শেষ নহে। প্রতি লেখা প্রকাশের পরও চলিত পরবর্তী দফার বিশ্লেষণ ও বিচার, প্রয়োজনে পূর্বে অনুমতিপ্রাপ্ত লেখাও পরবর্তী বিশ্লেষণ ও পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে শাস্তিযোগ্য বলিয়া গণিত হইত। বস্তুত দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে প্রচার-নিয়ন্ত্রণবাদ যে স্তরে উন্নীত হয়, তাহা বিশ্বে নজিরবিহীন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। গত সপ্তাহান্তে প্রেসিডেন্ট থিন সেইনের কল্যাণে এই চরম-নিয়ন্ত্রণবাদ হইতে মায়ানমার-মঞ্চের প্রচারমাধ্যম মুক্তি পাইল, অন্তত তেমনটিই ভাবিতেছে বিশ্বপৃথিবী। গোটা দুনিয়ায় শুভসংবাদ হিসাবে ঘুরিতেছে মায়ানমারের এই নূতন সংস্কার, অর্ধশতকব্যাপী সামরিক শৃঙ্খলাবদ্ধ দেশটির বহু-প্রতীক্ষিত মুক্তি ও সংস্কার-পথে অগ্রসরণের অন্যতম ধাপ হিসাবে আলোচিত হইতেছে।
বহিঃপৃথিবী যদি এমন ভাবে, মায়ানমার-এর অভ্যন্তরে কিন্তু মুক্তি ও সংস্কারের উচ্ছ্বাস তত তীব্র নহে। মুক্তি ও সংস্কারের ইঙ্গিত তত সংশয়োর্ধ্বও নহে। বর্মার তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রক নূতন সংস্কারের কথা জানানো সত্ত্বেও সংশয়ের কালো মেঘ সরিতেছে না, কারণ, পূর্ব প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সেন্সর বোর্ড কিন্তু একেবারে উঠাইয়া দেওয়া হয় নাই। বোর্ড বোর্ডের স্থানেই থাকিবে, উল্লিখিত সদ্য-বাতিল আইনটি ছাড়া তাহার অন্যান্য ক্ষমতাবলিও একই থাকিবে। স্বভাবতই, বহু-সংকটে অভিজ্ঞ মায়ানমারবাসীর মনে প্রবল আশঙ্কা: সেন্সরশিপ আইন উঠিয়া গেলেও অন্যান্য আইনের মাধ্যমে সেই একই নিয়ন্ত্রণবাদ কায়েম থাকিবে, অর্থাৎ প্রয়োজনে প্রকাশিত লেখার শাস্তিদান একই ভাবে চালু থাকিবে। কোন লেখাকে কোন বে ব্যাখ্যা করা হইবে, তাহা ব্যাখ্যাকারীর মর্জির উপরই নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক অতীতে বহু সাংবাদিককে এই ভাবেই হাজতবাসে বাধ্য করা হইয়াছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও সেই আশঙ্কা উড়াইয়া দেওয়া যায় না। ফলত, এই নূতন ঘোষণার পর ইয়াঙ্গনের সংবাদ-মাধ্যমের তীব্র নিরাপত্তাবোধের অভাব আদৌ সরিবে কি না, তাহা যথেষ্ট অস্পষ্ট।
প্রসঙ্গত তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রকের প্রধান কর্তা টিন্ট সোয়ে অবশ্য গত অক্টোবরেই বলিয়াছিলেন, এমন ধরনের সংস্কার আসিতে চলিয়াছে। ফলে এই ঘোষণা আকস্মিক নহে, বরং দীর্ঘ পরিকল্পনা-প্রসূত। এইখানেই যাহা কিছু ভরসা। যে কারণে মায়ানমার সরকার গত বছর-দুয়েক ধরিয়া ক্রমান্বিত সংস্কারের ‘দীর্ঘ’ পরিকল্পনা ও তাহার প্রয়োগে ব্যাপৃত হইয়াছে, তাহার মধ্যে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক দূরদৃষ্টির ভূমিকা অনেকখানি। সেই একই দূরদৃষ্টির মাধ্যমে তাহারা নিশ্চয়ই বুঝিতে পারিবে যে আধুনিক মুক্ত সমাজে সংবাদ-মাধ্যমের উপর এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ ত্যাজ্য। প্রকাশ-পূর্ব কিংবা প্রকাশ-পরবর্তী, কোনও স্বৈরতন্ত্রী নিয়ন্ত্রণের গণ্ডিতেই আধুনিক সংবাদ-মাধ্যমকে বাঁধা যায় না। প্রেসিডেন্ট থিন সেইনের সরকারের যে বাস্তববোধের প্রশংসা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ব্রিটেনের মুখে মুখে, সেই বোধই শেষ পর্যন্ত মায়ানমারকে গণতন্ত্রের দিকে ঠেলিয়া দিবে, এই আশাটুকুই ভরসা। |