পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ভক্তজনেরা নিশ্চয়ই মনে করেন যে, তিনি দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন করিতেই মহাকরণে আসীন হইয়াছেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও বিভিন্ন উপলক্ষে নিজেকে কঠোর প্রশাসক হিসাবে বিজ্ঞাপিত করিয়া থাকেন। ভক্তের বিশ্বাস দোষের কিছু নয়, আত্মপ্রত্যয় তো অতি উত্তম বস্তু। কিন্তু রাজ্যপাটের বয়স সওয়া এক বছর অতিক্রম করিবার পরে নাগরিকরা বোধহয় মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার প্রশাসনের নিকট কিঞ্চিৎ কাজের কাজ দাবি করিতে পারেন। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার সহমর্মীদের একটি প্রধান অভিযোগ ছিল, তাহার প্রশাসন আপন কাজ তৎপর এবং নিরপেক্ষ ভাবে সম্পাদন করে না। এই অভিযোগ বহুলাংশে সত্য ছিল, তাহাতেও সন্দেহ নাই। হয়তো গৌতম দেব এবং সম্প্রদায় ভবিষ্যতে সেই সত্যও স্বীকার করিবেন। কিন্তু জমানা বদলের পরে প্রশাসনের হাল ফিরিবে, নিরপেক্ষতা ও তৎপরতার মান উন্নত হইবে, ইহাই প্রত্যাশিত ছিল। বাস্তবে কী ঘটিয়াছে?
বৃহস্পতিবার একটি শিশু এবং তাহার জননীর প্রতি অটো রিকশ চালক যে আচরণ করিয়াছে, তাহা এক কথায় মারাত্মক অপরাধ। তাহার পর তিন দিন সেই চালককে পুলিশ ধরে নাই। অতঃপর ঘটনার বিবরণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাইয়াছে, তাহার তাড়নায় পরিবহণমন্ত্রী সচল হইয়াছেন এবং দ্রুত অভিযুক্ত চালক গ্রেফতার হইয়াছেন। তাঁহার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দাখিল হইয়াছে, তাহা যথেষ্ট কঠোর কি না, তাহা লইয়াও সঙ্গত প্রশ্ন আছে, কিন্তু আপাতত সেই প্রসঙ্গ থাকুক। মূল প্রশ্ন ইহাই যে, পুলিশ যাহা সোমবার করিতে পারিল, তাহা বৃহস্পতিবার করিতে পারিল না কেন? পরিবহণমন্ত্রী যে ‘যুক্তি’ দিয়াছেন এবং যে ভাবে দিয়াছেন, তাহার সম্পর্কে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, এই ধরনের চাপে-পড়িয়া বিলম্বিত ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত এই প্রথম দেখা গেল না, কিছু দিন আগেই অটো রিকশ চালকের দৌরাত্ম্য এবং তাহার বিলম্বিত প্রতিক্রিয়ার কাহিনি নাগরিকরা দেখিয়াছেন। অটো চালকদের একাংশের দুর্ব্যবহার এবং দুর্ব্যবহার করিয়া পার পাইয়া যাইবার অভিজ্ঞতা নূতন নহে, কিন্তু বর্তমান সরকারের জমানায় সেই অভিজ্ঞতা কমিবার বদলে আরও বাড়িয়া গিয়াছে। সাম্প্রতিক ঘটনাটি তাহার একটি ভয়াবহ এবং উদ্বেগজনক দৃষ্টান্তমাত্র। স্বচ্ছন্দে বলা চলে, এ রকম তো কতই ঘটে।
নিছক তর্জনগর্জন এবং দৌড়াদৌড়ি করিয়া প্রশাসনকে উন্নত এবং তৎপর করা যায় না। উন্নত, তৎপর এবং নিরপেক্ষ প্রশাসনের একমাত্র উপায়, প্রশাসনের দায়িত্বে উপযুক্ত ব্যক্তিদের স্থান দেওয়া এবং তাহার পর তাঁহাদের নির্ভয়ে ও স্বাধীন ভাবে কাজ করিতে দেওয়া। বামফ্রন্টের শাসকরা এই দুই ক্ষেত্রেই ফেল করিয়াছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারও এ যাবৎ পাশ করিতে পারে নাই। উত্তরোত্তর সমাজে এই ধারণা তৈয়ারি হইতেছে যে, যূথশক্তি থাকিলে যাহা খুশি করিয়া পার পাওয়া যাইবে, বিশেষত যদি সেই যূথশক্তির পিছনে শাসক দলের সমর্থন থাকে। ইহা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ যে, ‘পরিবর্তন’-এর হাওয়ায় দ্রুত, অতি দ্রুত অটো রিকশ’য় উড়ন্ত পতাকার রং বদলাইয়া গিয়াছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্বে অটো চালকদের প্রকট ঔদ্ধত্য এবং দুরাচারের সহিত এই পতাকা-বদলের কোনও সম্পর্ক নাই, এমন তত্ত্বে মদন মিত্র মহাশয় কাহাকেও বিশ্বাস করাইতে পারিবেন কি? অটো রিকশ’র চালকদের অনাচার একটি লক্ষণ বই কিছু নয়, কিন্তু সেই কারণেই মুখ্যমন্ত্রীর অবিলম্বে তৎপর হওয়া কর্তব্য। তাহা না হইলে তাঁহার রাজ্য নৈরাজ্যের নামান্তর হিসাবেই গণ্য হইবে। শিষ্টের দমন এবং দুষ্টের পালনের দীর্ঘ ঐতিহ্যে এই রাজ্যের মানুষ অভ্যস্ত, তাহাই কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সযত্নে লালন করিতে চাহেন? বামফ্রন্টের অপশাসনের উত্তরাধিকারী হইয়া থাকাই কি তাঁহার লক্ষ্য? |