পঞ্জাবের শান্ত এক মেয়ে, মীরা। অনাবাসীকে বিয়ে করে ব্রিটেনে পৌঁছনোর পর তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে স্বামী কুণাল আহুজা। পরিণামে লন্ডনের রাস্তায় কার্যত অসহায় হয়ে ঘুরতে হয় মীরাকে। শেষ সম্বলটুকুও তুলে দিতে হয় খাবার জোগাড় করতে। খবর নয়, ‘ককটেল’ সিনেমার কাহিনি এটা। কিন্তু সেলুলয়েডের পর্দায় শুধু নয়, অনাবাসী বিয়ে সংক্রান্ত সমস্যা এখন এক আতঙ্কজনক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে বলে মনে করছে কেন্দ্র। পঞ্জাবে শুধু নয়, গোটা দেশেই। এ জন্য আলাদা করে আইন প্রণয়নের কথাও ভাবছে কেন্দ্র।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে শুরু করে অনাবাসী বিষয়ক মন্ত্রক, মহিলা কমিশন সর্বত্রই এ বিষয়ে অভিযোগের পাহাড় জমছে। পঞ্জাবে এই ধরনের ঘটনা সব চেয়ে বেশি। পাশাপাশি দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, এমনকী পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা অভিযোগের সংখ্যাও কম নয়। বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে কেন্দ্র। বিভিন্ন মন্ত্রক এবং রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়া একটি সংসদীয় কমিটি এ ব্যাপারে সরকারের কাছে সম্প্রতি একটি রিপোর্ট পেশ করেছে। তাতে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, ভারতীয় বধূদের স্বার্থ রক্ষায় একটি ‘বিশেষ অনাবাসী বিবাহ আইন’ চালু করা হোক।
রিপোর্টের বক্তব্য, ‘বিশেষ আইনটির মাধ্যমে বিপদগ্রস্ত এবং দেশে ফেলে রেখে যাওয়া স্ত্রীদের সমস্যা মোকাবিলার জন্য মহিলাদের হাতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র তুলে দেওয়া সম্ভব হবে। বিবাহ বিচ্ছেদ, খোরপোষ, সন্তানের অধিকার ইত্যাদি বিষয় সামগ্রিক ভাবে বিচার করবে এই আইন।’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তার বক্তব্য, “বর্তমান আইনগুলির কিছু সংশোধন করে এবং বেশ কিছু নতুন আইন সংযোজন করে ভুক্তভোগীদের সম্পত্তির ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার রক্ষার কথা ভাবা হচ্ছে। যাতে তাঁদের বিবাহে সম-অধিকার বজায় থাকে, পরিবার সুরক্ষিত থাকে, অমানবিক ব্যবহার ও নির্যাতন যাতে সহ্য করতে না হয়নতুন আইন এই বিষয়গুলির দিকে নজর রেখেই করা হবে।” |
ককটেল ছবির দুই চরিত্র মীরা-কুণাল |
প্রশ্ন হল দেশেও তো এমন সমস্যার শিকার হতে হচ্ছে বহু মহিলাকে। শুধু অনাবাসী স্বামীর পরিত্যক্তাদের জন্যই কেন আলাদা করে আইনের ভাবনা?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য, এটা ঠিক যে উত্তরপ্রদেশ, বিহার বা দেশের বিভিন্ন রাজ্যে আখছারই বধূ নির্যাতন, স্ত্রীকে পরিত্যাগ বা প্রতারণার মতো ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এই সব ক্ষেত্রে মহিলারা দেশীয় আইন ও সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা পেতে পারেন। বাস্তবে সে সুযোগ সবাই পান কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, দেশে তা-ও গ্রামের মুখিয়ার কাছে গিয়ে একটা নালিশ ঠোকার অন্তত সুযোগ থাকে। কিন্তু বিদেশে? সেখানে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে মহিলারা অনেক বেশি অসহায় হয়ে পড়েন। এর পর স্ত্রীকে চাপ দিয়ে দেশে তার বাড়ি থেকে নিয়মিত অর্থ আদায়ের মতো ঘটনাও ঘটে।
বিদেশবিভুঁইয়ে গিয়ে স্বামীর কাছ থেকে উপযুক্ত মর্যাদা বা অধিকার আদায় করাটাও ঢের বেশি শক্ত। অনেকই ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ইংরেজি বা সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা জানা নেই। আইএসডি করতে হলেও লাগবে সে দেশের মুদ্রা। আর সব চেয়ে বড় তফাত, সে দেশের আইন।
সংসদীয় কমিটির রিপোর্টে বলা হচ্ছে, অনাবাসী ভারতীয়রা বিদেশের ডিভোর্স সংক্রান্ত তুলনামূলক উদার আইনের সুযোগ নিয়ে এই দুষ্কর্মটি চালিয়ে যাচ্ছে। বিদেশের আদালতে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পরে ভারতের আদালতে খোরপোষের দাবি আদায় করতেও যথেষ্ট আইনি হাঙ্গামা পোহাতে হয়। ফলে ‘পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলেই দাবি করা হয়েছে ওই রিপোর্টে।
কেন্দ্রও তাই কমিটির প্রস্তাবগুলি গুরুত্ব দিয়ে বিচার করে দেখছে। সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে শীঘ্রই পদক্ষেপ করা হবে। দু’বছর আগেই বিষয়টি নিয়ে একটি বিশেষ সেল তৈরি করেছিল জাতীয় মহিলা কমিশন। এ পর্যন্ত সেখানে অনাবাসী স্বামী পরিত্যক্তাদের অভিযোগের সংখ্যা প্রায় ছ’শো। অন্যান্য রাজ্যের (যেমন, দিল্লি, হরিয়ানা, পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র) তুলনায় কম হলেও পশ্চিমবঙ্গ থেকেও কমিশনের কাছে এ বিষয়ে ১৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে। রাজ্যে-রাজ্যে পুলিশের কাছে দায়ের হওয়া অভিযোগের সংখ্যাটা নিঃসন্দেহে বহু গুণ বেশি।
দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীকে পরিত্যাগ করার ঘটনা ঘটছে বিদেশ যাওয়ার ঠিক পরেই। অনেক সময় যাওয়ার পথেও এই ঘটনা ঘটছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে স্বামীর পেশা, অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্য, রোজগার, সম্পত্তি, এমনকী ইতিমধ্যেই সে বিবাহিত কিনা এই বিষয়গুলি সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলা হচ্ছে। পাশাপাশি শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের ঘটনা তো আছেই।
এমন নয় যে শুধুমাত্র অশিক্ষিত অথবা অর্ধশিক্ষিত গ্রামের মেয়েদেরই ঠকানো হচ্ছে। ফাঁদে পড়ছেন শহরের শিক্ষিত মহিলারাও। |