দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে যে সব কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মনমোহন সিংহের সরকার, তার কোনওটাই প্রায় বাস্তবায়িত করতে পারছে না তারা। অথচ প্রথম দফার ‘সাফল্য’কে পুঁজি করেই ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে জিতেছিল ইউপিএ। কিন্তু তার পর থেকেই আটকে গিয়েছে সরকারের রথ। আর্থিক বৃদ্ধির নিম্নগতি বা মূল্যবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি, কোনওটাই সামলাতে পারছে না সরকার! সামাজিক প্রকল্পগুলিতেও প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও দুর্নীতির ছায়া পড়েছে। শরিক-বিরোধীদের আপত্তিতে সংস্কারের রথের চাকায় লাগাম কষতে হচ্ছে সরকারকে। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো রয়েছে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ। এ বারে কয়লা ব্লক সংক্রান্ত আর্থিক কেলেঙ্কারিতে সরাসরি নিশানায় চলে এসেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। সব মিলিয়ে এক চূড়ান্ত সঙ্কটের মুখোমুখি ইউপিএ তথা তার প্রধান শরিক কংগ্রেস।
লালকৃষ্ণ আডবাণী-সুষমা স্বরাজের মতো বিজেপি নেতারা মনমোহনের ইস্তফার দাবিতে সরব হয়ে সংসদের চলতি অধিবেশন স্তব্ধ করে সরকার ফেলে দেওয়ার মতো প্রবল চাপ বাড়ানোর কৌশল নিতে চাইছেন। ততটা আক্রমণাত্মক না হলেও সরকারের সহযোগী মুলায়ম-মায়াবতীরাও এখন বিরোধীদের সুরে সুর মিলিয়ে সংসদ অচল রেখে সরকারের বিরোধিতায় নেমেছেন। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী আজ বিরোধীদের বার্তা দিয়ে বলেছেন, “আমি আলোচনায় রাজি।” কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতির কোনও বদল হয়নি।
এত সঙ্কট কী ভাবে সামাল দেওয়া হবে, তা নিয়েই এখন নাজেহাল কংগ্রেস নেতৃত্ব। বিরোধীদের আক্রমণে আজ সংসদের অধিবেশন বন্ধ করে দিতে হয়। এই সপ্তাহে অধিবেশন সুষ্ঠু ভাবে চলবে কি না, তা নিয়েই বিস্তর সংশয় রয়েছে। কয়লা ব্লক বণ্টন সংক্রান্ত অনিয়ম (যাকে বিরোধীরা কোল-গেট বলছেন) থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আড়াল করার জন্য সলমন খুরশিদ, পবন বনশল, অম্বিকা সোনি, মণীশ তিওয়ারি, রেণুকা চৌধুরির মতো কংগ্রেস নেতারা আজ দিনভর বিরোধীদের ‘দুরভিসন্ধি’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু ঘরোয়া স্তরে দলের অনেকেই বলছেন, “দলের একদা সঙ্কটমোচক এখন দেশের রাষ্ট্রপতি। বিরোধীদের কাছে পৌঁছে সঙ্কট সমাধান করার ব্যক্তির বড় অভাব।”
মনমোহন মন্ত্রিসভার এক শীর্ষ সদস্যের কথায়, “আর্থিক পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে, যে রাতারাতি তার সমাধান সম্ভব নয়। শরিক ও বিরোধীদের চাপে সংস্কারও থমকে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কোন পথে ইতিবাচক রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া যাবে, তা এখন কারও কাছে স্পষ্ট নয়।” সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের প্রেসিডেন্ট প্রতাপ ভানু মেটার মতে, “যে ভাবে সিএজি বা আদালত আজ সক্রিয় হচ্ছে, তার পিছনে কংগ্রেস নেতৃত্বের অবক্ষয় দায়ী। সনিয়া গাঁধী বা তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী রাহুল সংসদে কম কথা বলেন, সাংবাদিকদেরও কম মুখোমুখি হন। কিন্তু যখন তাঁরা বলতে শুরু করেন, প্রশাসনিক সমস্যা নিয়ে অভিযোগ তোলেন! তাঁরা ভুলে যান, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসলে তাঁরাই রয়েছেন।”
এই ডামাডোলের বাজারে মনমোহনকে আর প্রধানমন্ত্রী পদে রাখা হবে কি হবে না, তা নিয়েও একবার বিতর্ক শুরু হয়েছিল। আবার এই সঙ্কটের পরিস্থিতিতে রাহুলের অভিষেক যে মসৃণ হবে না, তা বিলক্ষণ জানেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। ফলে পরিস্থিতির মোড় ঘোরাতে প্রিয়ঙ্কাকে কতটা সক্রিয় করা হবে, তা নিয়েও জল মাপার কাজ চলছে। কিন্তু আর্থিক পরিস্থিতি থেকে দুর্নীতির অভিযোগ একের পর এক ঘটনায় কংগ্রেসের যে নাজেহাল দশা, কোন পথে তার নিদান মিলবে, তা জানেন না কেউ। যে মুলায়ম-মায়াবতী সরকারের সঙ্কটে প্রায়শই পরিত্রাতার ভূমিকা নেন, আজ তাঁরাও দুর্নীতি প্রশ্নে প্রকাশ্যে সরকারকে সমর্থন করছেন না। সীতারাম ইয়েচুরি-গুরুদাস দাশগুপ্তরা সংসদ একেবারে অচল হয়ে যাক, এমন না চাইলেও দুর্নীতি প্রশ্নে কোনও ভাবেই আপস করতে নারাজ। তার মধ্যেই আজ রাজ্যসভায় হট্টগোলের মধ্যে সংসদীয় মন্ত্রী রাজীব শুক্ল ডেপুটি চেয়ারম্যানের কানে ফিসফিস করে বলেন, “বিরোধীরা সারা দিন হট্টগোল করবে। ফলে দিনভরের জন্য সংসদ মুলতুবি করে দিন।” মন্ত্রীর মন্তব্য মাইক্রোফোনের দৌলতে কানে যেতেই বিরোধীদের সুর আরও চড়া হয়েছে।
কংগ্রেস ও সরকারের এই দুর্দশার ফসল ঘরে তুলতে মরিয়া বিজেপি। দলে নেতৃত্বের সঙ্কট যা-ই থাকুক, তা এখন প্রকাশ্যে আনছেন না বিজেপি নেতারা। দলের শীর্ষ নেতা অরুণ জেটলি বলেন, “সাম্প্রতিক কয়েকটি উপনির্বাচনেই স্পষ্ট হয়েছে, কংগ্রেসের জনপ্রিয়তায় অবক্ষয় ঘটছে। মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও ভাবেই অনুপ্রেরণা দিতে পারছে না।” এই সূত্রেই কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী এবং রাহুল গাঁধীকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, “কংগ্রেসের যাবতীয় গতিবিধি কেন্দ্রীভূত দলের প্রথম পরিবারকে ঘিরে! আর যখন সেই প্রথম পরিবারের সদস্যরা উপযুক্ত পদক্ষেপ করতে ব্যর্থ হন, তখন গোটা দলটাই ভেঙ্গে পড়ে। ফলে লোকসভা নির্বাচনে দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কংগ্রেসের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা যে বাড়ছে, তা আর কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।” |