আর্থিক সংস্কারের পথে বাধা কাটাতে ইউপিএ-র শরিক দলগুলির সমর্থন চাইতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। তবে খালি হাতে নয়। মূলত সংস্কারে গতি আনার বিষয়ে আলোচনা করতেই আগামিকাল বৈঠকে বসেছে ইউপিএ সমন্বয় কমিটি। যাতে যোগ দিতে আজ দিল্লি এসে পৌঁছেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সেই বৈঠকের মুখে পশ্চিমবঙ্গের জন্য আর্থিক প্যাকেজ নিয়ে তৎপর কেন্দ্র।
এই ‘দেওয়া-নেওয়া’র রাজনীতি প্রসঙ্গে সরকারের শীর্ষ সূত্রে দু’টি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার কথা বলা হচ্ছে। প্রথমত, গত কাল রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কেন্দ্রীয় রাজস্বসচিব সুমিত বসুর বৈঠক। এবং দ্বিতীয়ত, আগামিকাল সন্ধ্যায় মমতার সঙ্গে সাক্ষাতের আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাব্য বৈঠক। উল্লেখ্য, সমন্বয় কমিটির বৈঠকের পরে মমতাও রাষ্ট্রপতি ভবন যাবেন নৈশভোজের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে।
রাষ্ট্রপতি ভবনের পক্ষ থেকে প্রণববাবুর সঙ্গে সুমিত বসুর বৈঠককে ‘সৌজন্যমূলক’ আখ্যা দেওয়া হলেও কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্রে কিন্তু বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক প্যাকেজের বিষয়টি নিয়েই দু’জনের মধ্যে ঘরোয়া আলোচনা হয়েছে। প্রণববাবু কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন সুমিতবাবু ছিলেন ব্যয়সচিব। ঋণগ্রস্ত তিন রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব এবং কেরলের বিষয়ে কী করা যায় তা ঠিক করতে সুমিতবাবুর নেতৃত্বেই কমিটি গড়ে দিয়েছিলেন প্রণববাবু। রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গেও এই দু’জনের একাধিক বৈঠক হয়েছিল। তার পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা সেরে রাজ্যকে কেন্দ্রের প্রস্তাব জানান প্রণববাবু। |
সেই প্রস্তাব অবশ্য মেনে নেননি মমতা। রাজ্যের ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের উপরে তিন বছর স্থগিতাদেশের দাবিতে অনড় ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় যা মানা সম্ভব নয় বলেই কেন্দ্রের যুক্তি। এর পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে কংগ্রেস-তৃণমূল তিক্ততার জেরে আর্থিক প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু কংগ্রেস এখন তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করতে চাওয়ার পাশাপাশি সংস্কারের প্রশ্নে তাদের পাশে পেতে চাইছে। ফলে আর্থিক সহযোগিতার ব্যাপারে ফের তৎপর হয়ে উঠেছে কেন্দ্র। সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের মতে, আগামিকাল প্রণব-মনমোহন বৈঠক সেই পরিপ্রেক্ষিতেই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক পরিস্থিতি যে ভাল নয় সেটা সবার জানা। ঋণের বোঝা উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থা কাটাতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে প্রায় কুড়ি হাজার কোটি টাকা দিতে কেন্দ্র তৈরি। গ্রাম ও নগর উন্নয়ন, পরিকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ইত্যাদি খাতে ওই অর্থ দেওয়া যেতে পারে।
এই ধরনের প্যাকেজ দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন সময়টাও অনুকূল বলে মনে করছেন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। সরকারের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে প্যাকেজ ঘোষণা হলে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলতে পারতেন। অভিযোগ উঠত, তৃণমূলের সমর্থন পাওয়ার জন্যই প্যাকেজ ঘোষণা করল কেন্দ্র। অন্য রাজ্যের সঙ্গে বৈষম্যের অভিযোগও উঠতে পারত।” কিন্তু এখন সেই সম্ভাবনা কম বলেই ওই নেতার মত। কারণ, সম্প্রতি বিহার ও উত্তরপ্রদেশকে আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার কথা বলেছে কেন্দ্র। অর্থ মন্ত্রকের পরামর্শে প্রকল্প ওয়াড়ি অর্থ সাহায্যের জন্য উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকও শুরু করে দিয়েছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি দল। আবার বিজেপি-শাসিত কর্নাটকে খরা মোকাবিলার জন্য কেন্দ্র অনুদান দিচ্ছে। এনডিএ-শাসিত পঞ্জাবেও অনাবৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের পাশে দাঁড়াচ্ছে কেন্দ্র।
এখন প্রশ্ন হল, পশ্চিমবঙ্গকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্রের এই তৎপরতা সত্ত্বেও মমতা কি সংস্কার প্রক্রিয়ায় সম্মতি দেবেন? কেন্দ্রের এক শীর্ষ মন্ত্রীর মতে, আর্থিক প্রস্তাবে মমতা আদৌ সন্তুষ্ট হবেন কিনা সেটা আগে দেখতে হবে। সে ক্ষেত্রে আরও কিছুটা দর কষাকষির সম্ভাবনা এখনও রয়েছে। তবে পরিস্থিতি আগের থেকে কিছুটা ভাল হবে বলে কংগ্রেস আশাবাদী। ওই মন্ত্রীর বক্তব্য, আর্থিক প্যাকেজ মনোমত হলেও খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি, পেনশন বিল, বিমা বিল, ফরওয়ার্ড কনট্রাক্ট চুক্তি নিয়ে মমতা আপত্তি জানাবেন। কিন্তু এর মধ্যে কিছু বিষয়ে কেন্দ্র এগোতে চাইলে তিনি বাধা না-ও দিতে পারেন। যেমন পেট্রোলের দাম বাড়লে মমতা প্রতিবারই সমালোচনায় সরব হন। কিন্তু তিনি এমন কিছু করেননি যাতে কেন্দ্রে সরকারের সঙ্কট হয়।
বস্তুত, দুর্নীতির প্রশ্নে সরকার যখন কোণঠাসা, তখন মমতার দিল্লি এসে ইউপিএ-র বৈঠকে যোগ দেওয়াকে ‘ইতিবাচক’ ইঙ্গিত হিসেবেই দেখছে কংগ্রেস মহল। কংগ্রেস নেতাদের একটা অংশের মতে, মমতার আসাটা এই বার্তাই দিচ্ছে যে, তিনি বিপদের দিনে কংগ্রেসের সঙ্গেই আছেন। পাশাপাশি তাঁর এ বারের সফরের গায়ে যাতে জাতীয় রাজনীতির উত্তাপ বিশেষ না লাগে, সে ব্যাপারেও সতর্ক মমতা। আপাতত তাঁর নজর রাজ্যের স্বার্থরক্ষার দিকেই।
কাল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ইউপিএ সমন্বয় কমিটির বৈঠকে অন্য শরিকদের উপস্থিতিতে স্বাভাবিক ভাবেই পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক প্যাকেজ নিয়ে কোনও আলোচনা হবে না। তবে সেই বৈঠকের আগে বা পরে মমতার সঙ্গে সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহের আলাদা কথা হতে পারে। রাজ্যের আর্থিক প্যাকেজের ব্যাপারে তখনই তৃণমূলনেত্রীকে বার্তা দিতে পারেন মনমোহন-সনিয়া। |