সুবর্ণ যাদব (নাম বদল) নামে এক পরিচারক চুরির দায়ে ধরা পড়েছিলেন বছর খানেক আগে। সেই থেকে হাওড়া জেলে বন্দি বছর কুড়ির ওই যুবক। অর্থাভাবে উকিল জোগাড় করতে না পারায় ১২ মাসে এক বারও ডাক পড়েনি আদালতে। কিংবা বাগবাজার-শ্রীরামপুর রুটের একটি বেসরকারি বাসের চালক শের সিংহ। বালিখালে এক সাইকেল আরোহীকে অনিচ্ছাকৃত ভাবে মেরে ফেলার অভিযোগে দু’মাসের বেশি জেল খেটে অবশেষে জামিন পেলেও মামলার ভূত এখনও তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
এমনই ‘ছোটখাটো’ অপরাধের বিচার দ্রুত শেষ করতে অভিযুক্তদের দোষ কবুল করে সাজার মেয়াদ কমানোর (প্লি বার্গেনিং) সুযোগ দিতে চাইছে রাজ্য সরকার।
কী এই ‘প্লি বার্গেনিং’?
আইন বলছে, বিচারকের অনুমতি নিয়ে কোনও অভিযুক্ত যদি আদালতে নিজের দোষ কবুল করেন, তা হলে তাঁর সাজার মেয়াদ কমিয়ে দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড (সিআরপিসি)-এর সংশোধিত সংস্করণে। এতে এক দিকে যেমন নিম্ন আদালতে মামলার ভার কমবে, তেমনই জেলে বিচারাধীন বন্দিদের চাপ কমবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, “প্রায় সব জেলেই বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা বাড়ছে। এক বছর কেটে গেলেও শুনানি শুরু হয়নি, এমন নজিরও আছে। ওই তালিকায় আছে ৮-১০ বছরের বিচারাধীন বন্দিও। তাড়াতাড়ি বিচার মিটিয়ে যাতে তাঁদের স্বাভাবিক সমাজজীবনে ফিরিয়ে দেওয়া যায় সেই চেষ্টাই করছে সরকার।” |
তবে বিচারাধীন বন্দি হলেই যে এই সুযোগ মিলবে, তা নয়। সিআরপিসি-তে বলা হয়েছে, ভারতীয় দণ্ডবিধির যে সব ধারায় অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর, কেবল সেই ধারাতেই অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতে দোষ স্বীকার করে শাস্তির মেয়াদ কমানোর আর্জি জানাতে পারবেন। কিন্তু আবেদনকারীর বয়স অবশ্যই ১৮ বছরের বেশি হতে হবে। তবে, অপরাধ মহিলা বা ১৪ বছরের নীচে কোনও শিশুর বিরুদ্ধে হলে এবং তাঁর অপরাধের দরুণ দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষতি হয়ে থাকলে ‘প্লি বার্গেনিং’-এর সুযোগ নিতে পারবেন না অভিযুক্ত। একই সঙ্গে, সব কোর্টেও ওই আবেদন গ্রাহ্য হবে না বলে জানিয়েছে আইন মন্ত্রক। রাজ্যের আইন ও বিচার দফতরের এক কর্তা বলেন, মূলত ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতেই ওই আর্জি জানাতে পারবেন অভিযুক্তেরা। তিনি জানান, অভিযুক্তকে নোটিস দিয়ে দোষ কবুল করার কথা আগাম জানাতে হবে আদালতকে। সেই মতো নির্দিষ্ট দিনে বিচারক অভিযোগকারীকে কোর্টে হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি করবেন। থাকবেন সরকার পক্ষের আইনজীবীও। তাঁদের উপস্থিতিতে অভিযুক্তকে নিজের অপরাধ স্বীকার করতে হবে।
তবে সরকারের এই উদ্যোগ কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে সংশয়ে স্বরাষ্ট্র ও আইন দফতরের আধিকারিকেরাই। তাঁদের বক্তব্য, সাধারণ ভাবে অধিকাংশ অভিযুক্তই নিজের পক্ষে রায় পাওয়ার আশা করেন। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরাও সে কথা বোঝান। এবং সেই ভরসাতেই বহু ক্ষেত্রে ঘটি-বাটি বেচে বছরের পর বছর মামলা লড়ে যান অভিযুক্তেরা। এই অবস্থায় কত জন আদালতে দাঁড়িয়ে দোষ কবুল করবেন, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “মামলা লড়লে শাস্তি কিংবা খালাস, দু’দিকই খোলা থাকে। তাই বছরের পর বছর মামলা লড়ে যান অভিযুক্তেরা। কিন্তু দোষ কবুল করলে সাজা অনিবার্য।” সে কথা ভেবে কত জন ওই পথে এগোবে, প্রশ্ন তুলেছেন আইন দফতরের অফিসারেরাই।
তা হলে আমেরিকা-সহ ইউরোপের একাধিক দেশে কেন সাফল্য পেয়েছে ‘প্লি বার্গেনিং’?
স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা বলেন, “ও সব দেশে খুব কম ক্ষেত্রেই বিচারপর্ব দীর্ঘায়িত হয়। পুলিশও আটঘাট বেঁধে মামলা সাজায়। অভিযুক্ত জানেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁর পক্ষে অথবা বিপক্ষে রায় বেরোবেই। তাই আগাম দোষ স্বীকার করে সাজা কমানোর প্রবণতা সেখানে বেশি।” |