মুদ্রা রাক্ষস
ব্লেড বানাতে খুচরো পাচার, বাজার জেরবার
দ্রুত বেগে ছুটছে একটা সাইকেল-ভ্যান। বস্তায় বোঝাই!
নিশুত রাতে মধ্য কলকাতার রাস্তায় এমন রহস্যময় যানটিকে দেখে সন্দেহ হয়েছিল টহলদার পুলিশের। থামানোর চেষ্টা করতে ভ্যান ফেলে রেখে চালক চম্পট দেয়। তার এক সঙ্গী ধরা পড়ে। বস্তা খুলতেই পুলিশের চক্ষু চড়কগাছ! ১ টাকা থেকে শুরু করে ৫ টাকা নানা মূল্যের খুচরোয় সেগুলো ঠাসা!
ক’বছর আগের ওই ঘটনাটির দিন কয়েক পরে মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বস্তাবোঝাই খুচরো-সহ দু’জন পাকড়াও হয়। আর এ সবের জেরেই ভিন দেশে খুচরো পাচারের কথা প্রথম জানতে পারেন গোয়েন্দারা।
পুলিশ-সূত্রের দাবি: জেরায় ধৃতেরা জানায়, বস্তাগুলো সীমান্তের ও-পারে পাচার করা হচ্ছিল। মূলত ব্লেড তৈরির জন্যই কিছু পড়শি দেশে ভারতীয় মুদ্রার নাকি প্রবল চাহিদা! জানা গিয়েছে, পয়সা গলিয়ে ধাতব পাত বানিয়ে তা দিয়ে ব্লেড তৈরি হয়। কখনও এ দেশেই পাত বানিয়ে সীমান্ত পার করা হয়। কখনও সরাসরি খুচরো চালান হয় বস্তাবন্দি হয়ে।
মধ্য কলকাতার পথে বস্তাভর্তি খুচরো আটক হওয়ার পরেই লালবাজার তদন্ত শুরু করেছিল। ভিন দেশের ‘ব্লেড-শিল্পে’ ভারতীয় খুচরো পয়সা (চলতি ভাষায়, রেজকি)-র কদর সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত হওয়ার পরে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে অবহিত করে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগও তদন্তে নামে।
কী জানা গেল?
গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: মূলত ১, ২ আর ৫ টাকার খুচরো পাচার হচ্ছে। ১ টাকার একটা মুদ্রায় যত ধাতু থাকে, তা দিয়ে অন্তত চারটে ব্লেড হয়। ৫ টাকার মুদ্রার ক্ষেত্রে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ থেকে সাতে। গোয়েন্দারা জেনেছেন, পড়শি দেশে এক-একটা ব্লেডের দাম ভারতীয় মুদ্রায় কম করে পাঁচ টাকা। ফলে এ দেশের খুচরো পয়সা দিয়ে ব্লেড বানিয়ে বেচলে ‘উৎপাদন খরচ’ বাদ দিয়েও বিস্তর লাভ থাকে। খোঁজ নিয়ে তদন্তকারীরা এ-ও জেনেছেন, ভিন দেশের ছোট ছোট ব্লেড নির্মাতারা বাজার থেকে উন্নতমানের ধাতু কিনতে পারে না। তাই ‘সস্তার’ উপাদান হিসেবে খুচরো পয়সার এত কদর তাঁদের কাছে।
কিন্তু ভারতীয় মুদ্রাই কেন?
হাওড়া বাসস্ট্যান্ডে খুচরোর বিকি-কিনির ছবি।
কেন্দ্রীয় রাজস্ব-গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতীয় পয়সায় যে ধাতু (স্টেনলেস স্টিল) ব্যবহার করা হয়, তার গুণগত মান খুব উন্নত। স্বভাবতই তা দিয়ে যে ব্লেড তৈরি হয়, তারও মানও অনেক ভাল। লাভজনকও বটে।
লোভনীয় ‘উপাদান’টি ভিন দেশের ব্লেড-কারবারীদের হাতে পৌঁছায় দু’ভাবে। কী রকম?
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের ব্যাখ্যা: রাজ্যের বাজার থেকে সংগ্রহ করা খুচরো পয়সা চলে যায় স্থানীয় কিছু ফাউন্ড্রি বা ফেরো অ্যালয় কারখানায়। সেখানে মুদ্রা গলিয়ে ধাতব পাত বানানো হয়। সেই পাত পাড়ি দেয় পড়শি দেশে। সেখানকার কারখানায় তা দিয়ে ব্লেড তৈরি হয়। সীমান্ত পেরোনোর সময়ে বিএসএফের হাতে হামেশাই এ ধরনের ধাতব পাত ধরা পড়ে। শহরের কয়েকটি ফেরো অ্যালয় কারখানায় হানা দিয়েও এর প্রমাণ মিলেছে বলে গোয়েন্দা-সূত্রের দাবি। এ ছাড়া প্রচুর পরিমাণ খুচরো সরাসরি পাচার হয়। ভিন দেশি নির্মাতারা সেগুলো গলিয়ে পাত বানিয়ে ব্লেড তৈরি করেন। “মজার কথা, আমাদের পয়সা গলিয়ে বানানো ব্লেড অনেক সময়ে আমাদের দেশেই আমদানি হচ্ছে!” বলেন এক গোয়েন্দা-কর্তা।
এখন প্রশ্ন, ‘পাচারযোগ্য’ এত খুচরো জোগাড় হচ্ছে কী ভাবে? জোগাড় করছেই বা কারা?
তদন্তকারীদের দাবি: ভারত, বিশেষত কলকাতা থেকে খুচরো পাচারের একটা ‘চক্র’ গজিয়ে উঠেছে। শহর-শহরতলি জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিস্তর বড়-মেজ-ছোট দালাল ‘বাট্টা’ (কমিশন) দিয়ে খুচরো কিনছে। অনেক অটোচালক, ছোট ব্যবসায়ী এমনকী, গৃহবধূরাও তাদের কাছে ‘রেজকি’ বেচছেন। ব্যক্তি ও ক্ষেত্রবিশেষে ‘বাট্টা’র হার ২৫% থেকে ৮%। এই এজেন্টরা নিজেদের ‘লাভ’ রেখে মুদ্রার পসরা তুলে দিচ্ছে পাচার-চক্রের চাঁইদের হাতে। টান পড়ছে আম-জনতার পকেটে। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, “শুধু দালালদের দেখে চক্রের বহরটা আঁচ করা যাবে না। এটা পিরামিডের মতো। মাথায় বসে রয়েছে মূল চক্রীরা।”

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের জবাব (কলকাতা)
জোগান কি কম?
না। গত দু’বছরে সরবরাহ পর্যাপ্ত।

কতটা?
২০১০-২০১১ সালে ৭৪ কোটি ৪০ লক্ষ ১০ হাজার।
২০১১-২০১২ সালে ৭৭কোটি ১০ লক্ষ ৯০ হাজার।

কী ভাবে সরবরাহ?
আরবিআইয়ের কয়েন-ভেন্ডিং মেশিন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত
ব্যাঙ্কের ২১১টি খুচরো বিনিময়কেন্দ্র মারফত।
তবে আকালের অন্যতম কারণ পাচার হলেও তা একমাত্র কারণ নয়। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, দেশের ভিতরে খুচরোর কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতেও চক্রটি রীতিমতো সক্রিয়। যে কারণে অভিযোগ উঠেছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাউন্টারে গিয়ে অনেকে খুচরো পাচ্ছেন না। দেখা যাচ্ছে, সাতসকালে কিছু ছেলে কাউন্টারে লাইন দিয়ে প্রচুর পয়সা তুলে নিচ্ছে। ফলে নিরাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে বাস-মালিক, অটোচালক বা মাঝারি-ছোট ব্যবসায়ীদের, ‘রেজকি’ ছাড়া যাঁদের কারবার অচল। তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন ‘চক্রের’ কাছ থেকে বেশি দামে খুচরো কিনতে।
এবং পুলিশ-সূত্রের খবর: হাওড়া, ফুলবাগান-সহ মহানগরের বিভিন্ন বাস স্ট্যান্ডে খুচরোর এই ‘বিকি-কিনি’ চলছে অবাধে। পূর্ব কলকাতার অটোচালক বাবলু বর্ধনের আক্ষেপ, “সপ্তাহে দু’-তিন দিন বাট্টা দিয়ে খুচরো কিনতে হচ্ছে। হাজার টাকায় লাগছে এগারোশো দশ! কত দিন চালাব?” শহরের এক বাস-মালিক প্রদীপ পালের অভিযোগ, বিভিন্ন ব্যাঙ্ক আয়োজিত ‘কয়েন মেলা’ থেকেও একই কায়দায় খুচরোর পাহাড় তুলে নিয়ে যাচ্ছে দালালেরা।
ব্যবসায়ী মহলের তথ্য: সরকারের ঘর থেকে ‘ন্যায্য’ দরে খুচরো তুলে গুদামে লুকিয়ে রাখা হয়। একটা অংশ বিদেশে পাচার হয়, বাকিটা ‘চাহিদা’ বুঝে ছাড়া হয় বাজারে।
পুলিশ ও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, খুচরো-কারবার এখন এতটাই ‘আকর্ষণীয়’ যে, বহু লোক ‘চক্রে’ সামিল না-হয়েও এতে নেমে পড়েছেন। ফুটপাথের গেঞ্জি-বিক্রেতা থেকে সাধারণ ঘরের মেয়ে-বৌরাও থলিতে ‘রেজকি’ ভরে বাস স্ট্যান্ডে বেচতে আসছেন। শহরের আনাচে-কানাচে এই জাতীয় ‘খুচরো বাজার’ গজিয়ে ওঠার কথা কেন্দ্রীয় রাজস্ব-গোয়েন্দাদেরও কানে এসেছে। তাঁদের ধারণা, স্থানীয় দুষ্কৃতীদের মদত ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
শহরের পুলিশ কী বলছে?
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষের আশ্বাস, “খোঁজ নেওয়া হবে।”

(সহ প্রতিবেদন: সুনন্দ ঘোষ, প্রেমাংশু চৌধুরী)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.