কথা ফোটেনি। ভাবে-ভঙ্গিতেই মনের কথা বোঝাতে চাইছে দেড় বছরের শিশুটি। জ্বর আছে, সর্দিও। মাঝেমধ্যেই কান্না। কাউকে আঁকড়ে ধরতে বাড়িয়ে দিচ্ছে আকুল দু’হাত। শশব্যস্তে এগিয়ে আসছেন নার্স, আয়ারা। বাৎসল্যের উত্তাপে নিশ্চিন্ত করছেন মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা শিশুটিকে।
রবিবার রাতে লিলুয়া স্টেশন রোডে একটি বড় নিকাশি নালার জলে শিশুটিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সাইকেলে চড়ে পালিয়ে যায় একটি পুরুষ এবং এক মহিলা। রাস্তার কলে জল নিতে গিয়ে ব্যাপারটা দেখতে পান গুণবাহাদুর শর্মা নামে এলাকার এক বাসিন্দা। নালায় নেমে শিশুটিকে উদ্ধার করেন তিনি। সেই ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরেও পরিচয় মেলেনি শিশুটির। জয়সোয়াল হাসপাতালের দোতলায় মহিলা বিভাগই এখন তার ঠিকানা।
তবে হাসপাতালের এই ছোট অতিথির আদরযত্নে কোনও খামতি রাখছেন না ওই বিভাগের নার্স, আয়ারা। কান্না শুরু করলেই এগিয়ে যাচ্ছেন কেউ না কেউ। তুলে নিচ্ছেন কোলে। সময়মতো মিলছে খাবারও। পরানো হয়েছে নতুন জামাপ্যান্ট। রবিবার রাতেই বালি থানার ওসি দীপক সরকার ও অন্য পুলিশকর্মীরা চিকিৎসকদের কথামতো বেবি ফুড আর জামাপ্যান্ট কিনে দিয়েছিলেন। এক পুলিশকর্মীর কথায়, “এত ছোট বাচ্চা! কারা ফেলে গেল, সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। কী কিনে দিলাম, সেটা বড় কথা নয়।” |
পুলিশি সূত্রের খবর, রবিবার রাত থেকেই জয়সোয়াল হাসপাতালের মহিলা বিভাগে এক জন মহিলা কনস্টেবলকে পাহারায় রাখা হয়েছে। যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না-ঘটে। ওই রাতেই বালি ও লিলুয়া থানার অফিসারেরা মোবাইলে শিশুটির ছবি তুলেছিলেন। ব্লু-টুথের মাধ্যমে সেই ছবি দেওয়া হয়েছে অন্য অফিসারদের মোবাইলে। এক অফিসার বলেন, “ওই ছবি বিভিন্ন এলাকায় দেখানো হচ্ছে। যদি কেউ চিনতে পারে, খুব ভাল হয়।” সেই সঙ্গেই লিলুয়া থানা এলাকায় কোনও শিশু নিখোঁজ আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বালি, লিলুয়া বা সংলগ্ন অন্য কোনও থানাতেই ওই বয়সের শিশু নিখোঁজের ডায়েরি হয়নি।
হাওড়া সিটি পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, শিশুটির ছবি হাওড়া পুলিশ কমিশনারেটের ওয়েবসাইটের ‘মিসিং পোর্টাল’-এ দেওয়া হয়েছে। ছবি পাঠানো হয়েছে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন থানাতেও। পুলিশ কমিশনার অজেয় রানাডে বলেন, “শিশুটির পরিচয় জানার জন্য সব রকম চেষ্টা চালানো হচ্ছে। হাসপাতাল থেকে ছুটি দিলে তবেই ওকে শিশু কল্যাণ কমিটির কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। তার পরে পাঠানো হবে কোনও হোমে।”
জয়সোয়াল হাসপাতাল সূত্রের খবর, জলে ভিজে দেড় বছরের শিশুটির সর্দিজ্বর হয়েছে। এ ছাড়া তেমন কোনও সমস্যা নেই। হাসপাতালের সুপার অপরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমি নিজে শিশুটিকে পরীক্ষা করেছি। এখন অনেকটা সুস্থ।”
কী বলছেন শিশুটির রক্ষাকর্তা গুণবাহাদুর শর্মা? এলাকার একটি কারখানার দারোয়ান গুণবাহাদুর কাজে ব্যস্ত থাকায় সোমবার আর হাসপাতালে যেতে পারেননি। কিন্তু সব কিছুর মধ্যেও রবিবার রাতের ঘটনাটা ভুলতে পারছেন না তিনি। নালায় নেমে উদ্ধারের পর থেকে হাসপাতালে ভর্তি করানো পর্যন্ত শিশুটি কী ভাবে তাঁকে আঁকড়ে ধরে ছিল, বলতে গিয়ে গলা কেঁপে যাচ্ছে গুণবাহাদুরের। শিশুটিকে নিজের কাছেই রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। সে-কথা বলেওছিলেন পুলিশকে। দুই মেয়ের বাবা গুণবাহাদুর সোমবার অবশ্য বলেন, “আমার এত ক্ষমতা নেই যে, ওকে মানুষ করব। ওর জীবন বাঁচাতে পেরেছি, এটাই বড় কথা। ভগবানের কাছে সারা জীবন প্রার্থনা করব, ও যেন ভাল থাকে, বড় হয়।” |