চিনের তিনটি সমস্যা: আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া, রফতানির বাজার নষ্ট হওয়া
এবং মূল্যস্ফীতি। ভারতের গায়েও সেই বিপদের আঁচ লাগবে কি? আলোচনা করছেন তপন ভৌমিক |
গোটা দুনিয়া যখন আর্থিক মন্দায় হাবুডুবু খাচ্ছিল, তখন দুটো দেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল ভারত আর চিন। কিন্তু তার পর ভারতের অর্থনীতি হঠাৎই ধাক্কা খেয়েছে। এখন আবার আশঙ্কা, চিনের অর্থনীতিও থমকে দাঁড়াল বুঝি! আশঙ্কার কারণটা স্পষ্ট। এই বছরের প্রথম ভাগে চিনের আর্থিক বৃদ্ধির হার মাত্র ৭.৬ শতাংশ। হিসেব-টিসেব করে দেখা যাচ্ছে, এই বছর ৭.৫ শতাংশের বেশি হারে আয় বাড়ার সম্ভাবনা নেই। গত তিন দশক ধরে চিন বছরে গড়পড়তা সাড়ে দশ শতাংশ হারে আয় বাড়িয়েছে। সেই দেশে বৃদ্ধির হার ৭.৫ শতাংশে নেমে এলে আতঙ্ক অস্বাভাবিক নয়।
চিনের সমস্যা একটা নয়, তিনটে। প্রথম সমস্যার কথা ইতিমধ্যেই বললাম। দ্বিতীয় সমস্যা হল, আর্থিক মন্দার দৌলতে পশ্চিমি দুনিয়ার দেশগুলোর অবস্থা এখন এমনই খারাপ যে সেই বাজারে খুব বেশি রফতানি বাড়ানোর সুযোগ আপাতত নেই। ফলে, রফতানির খাতে যে আয় হত, তাতে ধাক্কা লেগেছে। তিন নম্বর সমস্যাটি মূল্যস্ফীতি।
অর্থনীতির তত্ত্বে, দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মোট চারটে উপাদান আছে ভোগ্যপণ্য কিনতে ক্রেতাদের ব্যয়; সরকারের ব্যয়; মোট বিনিয়োগ; এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে মোট লাভ, অর্থাৎ মোট রফতানি থেকে মোট আমদানি বাদ দিলে যা থাকে, সেই অঙ্কটি। বিভিন্ন দেশে এই চারটি উপাদনের অনুপাত বিভিন্ন হয়। চিনে বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই বেশি। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় অর্ধেকই বিনিয়োগ দেশি ও বিদেশি। একটা ছোট পরিসংখ্যান দিই ভারতে বছরে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যত, চিনে বছরে সেই পরিমাণ, বা তার চেয়েও খানিক বেশি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। এই বিনিয়োগের একটা বড় অংশ আবার যায় জমি-বাড়ির ক্ষেত্রে বিনিয়োগে এবং পরিকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে। একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, হঠাৎ করে জমি-বাড়ির দাম পড়ে যেতে পারে, ২০০৮-এর মন্দার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন ভাবে পড়েছিল। তেমনটা হলে অনেক ব্যাঙ্কই ঘোর বিপদে পড়বে, কারণ ব্যাঙ্কগুলি এই ক্ষেত্রে বিপুল ঋণ দিয়েছে। |
ভারতের তুলনায় চিন অনেক বেশি পরিমাণে বিশ্ব-বাজারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। ফলে, বিদেশের শেয়ার বাজারের ধসই হোক, অথবা অর্থনীতির ওঠা-পড়া, চিনের ওপর তার প্রভাব বেশ প্রকট ভাবেই পড়ে। এখন যেমন রফতানির বাজার খারাপ হওয়ায় চিনের অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে প্রভূত ছাঁটাই চলছে। যে শ্রমিকদের চাকরি যাচ্ছে, তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা একেবারে কমে যাচ্ছে, ফলে জাতীয় উৎপাদনের ভোগ্যপণ্য বাবদ ব্যয়ের ঘরে খানিক হলেও কম টাকা জমা পড়ছে। আর অন্য দিকে, বিপদের আঁচ পেয়ে চিনের মানুষ সাবধান হয়ে গিয়েছেন। এমনিতেই সে দেশের সঞ্চয়ের হার অতি চড়া। তার ওপর, আর্থিক সংকটের ছায়া দেখতে পেলেই চিনের মানুষ আরও খরচ কমিয়ে দেন, আরও বেশি করে সঞ্চয় করতে থাকেন। এখন তেমনটাই হচ্ছে। ফলে, আন্তর্জাতিক সংকট শুধু ‘বাইরের’ ব্যাপার হয়েই থাকছে না, চিনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়ছে।
তার ওপর রয়েছে মূল্যস্ফীতির সমস্যা। চিনের পার্টি মূল্যস্ফীতিকে বেজায় ভয় পায়। সূচক পাঁচ শতাংশের সীমা ছাড়ালেই সরকার রীতিমত অস্বস্তিতে পড়ে এই বুঝি সামাজিক অশান্তি আরম্ভ হল! এখন মুশকিল, মূল্যস্ফীতি অনেকটাই আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে ঘটছে। তার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। চিন ইদানীং খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে ক্রমে আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বাজারে খাবারের দাম বাড়লে সরকার খাদ্যপণ্যের জোগান বাড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, জোগান বাড়াতে গেলেই চিনকে বিশ্ব-বাজারে ক্রেতা হিসেবে পৌঁছতে হচ্ছে। আর চিন এমনই বড় দেশ যে সে ক্রেতা হলে বিশ্ববাজারে চাহিদা এমন ভাবে বাড়ছে যে মূল্যবৃদ্ধি অনিবার্য হয়ে উঠছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের আর একটি প্রচলিত পন্থা সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া। এ দিকে, সুদের হার বাড়ালে মানুষের সঞ্চয়-প্রবণতা আরও বাড়ে। তাতে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা খানিকটা কমে বটে, কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টাকার অভাব হয় না। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদের হার কমালেই বিভিন্ন প্রদেশে কিছু ‘ছায়া-ব্যাঙ্ক’ গড়ে ওঠে, যেখান থেকে বিনিয়োগের জন্য ঋণ পাওয়া যায়। ফলে, বিনিয়োগ হয়েই চলে। তাতে মূল্যস্ফীতির হারেও যথেষ্ট লাগাম পরানো সম্ভব হয় না।
সব মিলিয়ে, চিনের অর্থনীতি একটা পথসন্ধিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রশ্ন হল, তাতে ভারতের কী? এই ঘটনা নিয়ে কি আমাদের চিন্তিত হওয়া উচিত? কেউ কেউ হয়তো বলবেন, চিনের বিপদে ভারতের খুশি হওয়াই উচিত। চিনের অর্থনীতির যত গতিহ্রাস হবে, ভারত তত দ্রুত তার সমকক্ষ হতে পারবে। আবার অনেকেই বলবেন, চিনে এখন যা হচ্ছে, তা হওয়ারই ছিল। কোনও অর্থনীতিই চিরকাল সাড়ে দশ শতাংশ হারে বাড়তে পারে না। এক দিন সেই হার কমতে বাধ্য। সাড়ে সাত-আট শতাংশ বৃদ্ধির হারই স্বাভাবিক, সুস্থায়ী।
চিনের অর্থনীতি ধাক্কা খেলে বিশ্ব-অর্থনীতিতে তার বড়সড় প্রভাব পড়বে। ফলে, এখন যে সংকট চলছে, তা জটিলতর এবং দীর্ঘতর হতে বাধ্য। ভারতের ওপরও তার প্রভাব পড়বেই।
একটা কথা বলতে পারি চিনে এখনও এমন কিছু হয়নি যাতে ভাবতে হবে যে চিনের অর্থনীতি বুঝি ধসে পড়ল! সে সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। একই সঙ্গে আশা করব, চিনের সরকার অতি দ্রুত এমন ব্যবস্থা করবে যাতে সে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হারের নিম্নগতি রোধ করা যায়। চিনের স্বার্থেই এটা প্রয়োজন। দুনিয়ার স্বার্থেও।
|