সাক্ষাৎকার...
‘মা মাটি মানুষের ফাঁকা স্লোগানে পেট ভরবে না’

এ বিষয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায় যা বলেছেন, তা যে মনমোহন সিংহের বক্তব্যের থেকে খুব আলাদা, এমন আমার মনে হয় না। মনমোহনও বলবেন যে, চুঁইয়ে-পড়া সুযোগই যথেষ্ট নয়, দরিদ্রের উন্নয়নের জন্য আরও নানা উদ্যোগ নেওয়া উচিত। তবে আমার মনে হয় ওঁরা দু’জনেই বলবেন যে এই উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক বৃদ্ধির হার যাতে না কমে সে দিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে।
সরকারি নীতি কি সে কথা মাথায় রাখছে? মনমোহন সিংহ যে উদার অর্থনীতির সূচনা করেছিলেন, তার ফলে বেশ কয়েক বছর ভারতে আর্থিক বৃদ্ধি উঁচু হারে হল। অথচ দারিদ্র তেমন কমল কি?
লোকসংখ্যার আপেক্ষিক অনুপাতে দারিদ্রের হার গত দুই দশকে নিশ্চয়ই কমেছে, কিন্তু যথেষ্ট কমেনি। আর্থিক বৃদ্ধি কতটা বাড়লে দারিদ্র কতটা কমবে বলে প্রত্যাশা করা চলে, সে বিষয়ে অর্থনীতিতে একটি তাত্ত্বিক ধারণা ও পরিমাপের ব্যবস্থা রয়েছে। যদি জাতীয় আয়ে এক শতাংশ বৃদ্ধি হয়, তা হলে দেশে দারিদ্র কি অনেকখানি কমবে, না কি সামান্য কমবে? দেখা গিয়েছে এটা নির্ভর করে দেশের মানুষদের মধ্যে গোড়াতে অসাম্য কতখানি ছিল, তার উপর। যদি বৈষম্য বেশি থাকে, তা হলে আর্থিক বৃদ্ধি হলে গোড়াতে যেটুকু বাড়তি সম্পদ আসে তা বড় মাছেরাই খেয়ে ফেলে। গরিবদের কাছে পৌঁছয় না। চিনে এখন মানুষের রোজগারে অসাম্য বাড়ছে, কিন্তু ওদের আর্থিক বৃদ্ধি যখন শুরু হয়েছিল তখন সমাজে অনেকটাই সমতা ছিল। তাই সে দেশে আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত দারিদ্র কমেছে। ভারতে আর্থিক বৃদ্ধি হলেও দারিদ্র কমে সামান্যই, তা সমাজে অসাম্যের জন্য। কিন্তু এর মানে এই নয় যে আর্থিক বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই। বৃদ্ধি না হলে গরিব মানুষের কর্মসংস্থান কোথা থেকে আসবে? কিন্তু বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়।
পেটে চাই খাবার। স্কুলে মিড ডে মিল-এর খাওয়া চলছে। ছবি: অনির্বাণ সেন

জাতীয় স্তরে এই প্রশ্নের কোনও একটি উত্তর খুঁজে পাওয়া সহজ নয়, বরং বেশ জটিল। কারণ কেন্দ্রের নীতি এক হলেও, রাজ্যগুলি তা নানা মাত্রায় কাজে লাগিয়েছে। কেউ ভাল কাজ করেছে, কেউ করেনি। তামিলনাড়ু, রাজস্থান, হিমাচল প্রদেশ-- এই তিনটি রাজ্যের দিকে তাকালে যেমন দেখা যাচ্ছে যে সেখানে আর্থিক বৃদ্ধি এবং দারিদ্র হ্রাস, দুটোই হচ্ছে বেশ সন্তোষজনক হারে। তাদের সঙ্গে প্রতিতুলনা করা চলে গুজরাতের। সে রাজ্যে বেশ কয়েক বছর ধরে আর্থিক বৃদ্ধির হার সাড়ে দশ শতাংশেরও বেশি, যা চিনের সঙ্গে সমান। কিন্তু দরিদ্রের উন্নয়নের হার তামিলনাড়ু বা হিমাচলের চাইতেও কম। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, গুজরাতে শিশু অপুষ্টি ৪৩ শতাংশ। তামিলনাড়ু, হিমাচলের আর্থিক বৃদ্ধি গুজরাতের মতো বেশি নয়, কিন্তু শিশু অপুষ্টি অনেক কম। এমন কেন হচ্ছে, তার চটজলদি ব্যাখ্যা নেই। তামিলনাড়ুতে রাজনৈতিক নেতারা আমলাদের কাজে হস্তক্ষেপ কম করেন, এটা একটা কারণ হতে পারে। আবার অর্থনীতিবিদ জাঁ দ্রেজ আমাকে বলেছেন, উত্তর ভারতের থেকে তামিলনাড়ুতে অঙ্গনওয়াড়ি ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য তফাত হল, তামিলনাড়ুতে মাঝামাঝি স্তর থেকে নীচের স্তর পর্যন্ত কর্মীরা সকলেই মহিলা। এর জন্যও সে রাজ্যে শিশুর পুষ্টি চিত্রে পরিবর্তন এসে থাকতে পারে।


যে প্রকল্পগুলো নানা ধরনের শর্তসাপেক্ষে গরিবকে টাকা দেয়, যেমন স্কুলের উঁচু ক্লাসে মেয়েরা পড়লে তাদের অনুদান বা সাইকেল, অথবা বিধবা কিংবা বৃদ্ধদের ভাতা, সেগুলো ছোট মাপের হলেও তুলনায় ভাল কাজ করছে। যাঁদের এগুলো পাওয়ার কথা, তাঁরা না পেয়ে অন্যরা পেয়ে যাচ্ছেন, এমন খুব একটা শোনা যায় না। জনস্বাস্থ্য বিমা যোজনা, যা যৌথ উদ্যোগের প্রকল্প, তা-ও অন্ধ্র প্রদেশের মতো কয়েকটি রাজ্যে ভাল চলছে।
যে প্রকল্পগুলো চাহিদা সাপেক্ষে টাকা দেয়, তার মধ্যে এখন প্রধান হল একশো দিনের কাজ। প্রকৃত গরিবের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার কাজে এই প্রকল্পের সাফল্যকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মানতে হবে। তবে যত গরিবের এই প্রকল্পে কাজের প্রয়োজন ছিল, তত মানুষের কাছে এটা পৌঁছতে পারছে না, ঠিক সময়ে কাজের পারিশ্রমিকও পাওয়া যাচ্ছে না। এটা এই প্রকল্পের একটা বড় সীমাবদ্ধতা। কিন্তু এর গুরুত্ব এইখানে যে, গ্রামের শ্রমজীবী মানুষদের একটা বড় অংশের কাছে এটা একটা বিকল্প রোজগার হয়ে এসেছে, নিয়মিত কাজ না থাকলে তাদের অতটা নিরুপায় হয়ে পড়তে হয় না। এমনও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, এই প্রকল্পের ফলে মজুরি বেড়েছে, তাই সব সময়ে অন্য কাজের জন্য মজুরও পাওয়া যাচ্ছে না। এই প্রকল্পের যে ত্রুটিগুলো রয়েছে, সেগুলো অনেকটাই দূর করা যেত, যদি নিয়মিত ‘সোশ্যাল অডিট’ বা গ্রামের মানুষের হিসেবরক্ষণ করা সম্ভব হত। আর, যদি একশো দিনের কাজে গ্রামের মানুষের পরিকল্পনার ভিত্তিতে গ্রামের জন্য স্থায়ী সম্পদ তৈরি করা যেত।


যদি সরকারি খাদ্য বণ্টন ব্যবস্থার দিকে দেখা যায়, তা হলে বলতেই হবে যে ভর্তুকির সুযোগে স্বল্পমূল্যের খাবার গরিবকে পৌঁছে দিতে সরকারের ব্যর্থতাই বেশি। তামিলনাড়ু, কেরল, অন্ধ্র প্রদেশ, ছত্তিশগঢ়, এমন কয়েকটি রাজ্য ছাড়া বাকিদের অবস্থা বেশ খারাপ। এ বিষয়ে একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, খাদ্যে সরকার যা ভর্তুকি দেয় সেই অর্থমূল্যের মাত্র ১০ শতাংশ পৌঁছয় বি পি এল মানুষদের কাছে, ১৯ শতাংশ পায় এ পি এল। আর সবচেয়ে ভয়ংকর হল, ৪৩ শতাংশই বেআইনি ভাবে বাজারে পাচার করে দেয় রেশন ডিলাররা। বাকি ২৮ শতাংশ ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার অপচয় ও চুরিতে নষ্ট হয়।
লক্ষ করা যাচ্ছে যে, তামিলনাড়ু বা ছত্তিশগঢ়ের মতো যে সব রাজ্যে রেশন সর্বজনীন, এ পি এল-বি পি এল বিভাগ নেই, সেখানে দুর্নীতি কম। এর কারণ বোঝা কঠিন নয় যখনই দু’রকম দামের জিনিসের বাজার তৈরি হয় তখনই দুর্নীতির সুযোগ বাড়ে, লাভের আশাও বাড়ে। অন্য দিকে সকলকে খাবার দিতে গেলে খরচ অনেক গুণ বেড়ে যায়।
তাই আমি এবং আরও কয়েকজন অর্থনীতিবিদ একটা এমন ব্যবস্থার প্রস্তাব করছি, যেখানে গরিব বেছে বার করে কেবল তাদের খাবার দেওয়ার চাইতে, ধনী বেছে বার করে তাদের বাদ দেওয়া হোক। সে কাজটা অনেক সহজ, কারণ ধনী লোক এ দেশে কম। তাদের চিহ্নিত করাও সহজ। এমন একটি ব্যবস্থা প্রায় সর্বজনীন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আর সেই সঙ্গে দু’রকম দাম না থাকায় দুর্নীতির আকর্ষণও কমবে। অর্থাৎ রেশন ব্যবস্থায় এ পি এল-বি পি এল বিভাজন তুলে দিয়ে, অল্প কিছু ধনীকে বাদ দিয়ে, অধিকাংশ মানুষের জন্য নির্দিষ্ট মূল্যে খাবার দিলে তা গরিবের জন্য অনেক কার্যকর হবে। আর যদি কোনও রাজ্য গরিবের খাদ্যের পরিবর্তে নগদ টাকা দিতে চায়, তার স্বাধীনতা থাকা উচিত।


পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্রের আপেক্ষিক মাত্রা গত দুই দশকে কমেছে কিন্তু খুবই স্বল্প হারে। শিক্ষা আর স্বাস্থ্যে আমাদের গরিবদের অবস্থা অন্য অনেক জায়গার তুলনায় খারাপ। যেমন স্কুলে ক্লাস এইটের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ছাত্র স্কুলছুট হয়ে যায় (কেরলে ০ শতাংশ, তামিলনাড়ুতে ৯ শতাংশ)। স্বাস্থ্যের অনেক ব্যাপারে আমাদের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ছাড়াও যেটা সর্বপ্রধান প্রয়োজন, সেটা শিল্পায়ন ও লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য কর্মসংস্থান। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের যা উদভ্রান্ত নীতি দেখছি তাতে গরিব মানুষের জন্য আশা করতে ভরসা পাচ্ছি না। মা মাটি মানুষের ফাঁকা স্লোগানে তো পেট ভরবে না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.