দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে অসম পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নাকের ডগায় বসে নাশকতা চালিয়ে যাওয়া আলফার ৭০৯ নম্বর ব্যাটালিয়নের কম্যান্ডার, হীরা শরণিয়াকে এই প্রথম গ্রেফতার করল অসম পুলিশ। অরবিন্দ রাজখোয়ার শান্তিকামী আলফা দলে থাকা হীরা শান্তি-প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরে প্রকাশ্যে আসেন। হত্যা, অপহরণ ও ডাকাতির দায়ে আজ তাকে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশ জানায়, গত ৩১ জুলাই দিসপুরের শিকারিয়া আবাসনে ডাকাতির একটি ঘটনা ঘটে। বাড়ির মালিক রাজেন লোহিয়া ঘটনার সময় বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর কর্মী সুরেশকে হত্যা করে কয়েক লক্ষ টাকা লুঠ করে ডাকাতদল। সুরেশের মৃতদেহের সন্ধান মেলেনি। এরপর ২ অগস্ট, পানবাজার এলাকায় ব্যবসায়ী বিনীত জৈনও নিখোঁজ হন। পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে, দু’টি ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। এক তদন্তকারী অফিসার জানান, লোহিয়ার কর্মীর কাছে যে টাকা রয়েছে তার সন্ধান বিনীতই ডাকাতদের জানিয়েছিল। ডাকাতদলের পিছনে ছিল খোদ হীরা। হীরার সঙ্গে বিনীতের চুক্তি হয়েছিল, লুঠের টাকার একটি অংশ বিনীতও পাবে। কিন্তু ডাকাতির পরে বিনীতকে টাকা দিতে অস্বীকার করে হীরা। বিনীত হুমকি দে, টাকা না পেলে সে পুলিশকে সব বলে দেবে। এরপরেই বিনীতকে অপহরণ করা হয়। হীরার নির্দেশে তাকে হত্যা করে দেহ ব্রহ্মপুত্রে ফেলে দেওয়া হয়। আজ এসপি (অভিযান) রঞ্জন ভুঁইয়ার নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী নলবাড়ির হেলেসার থেকে হীরাকে গ্রেফতার করে। হীরা ছাড়াও ঘটনায় জড়িত তামুলপুরের পঙ্কজ কলিতা, গুয়াহাটির প্রদীপ চৌধুরী ও সরফরাজ আলি নওয়াজকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নওয়াজ পেশায় আইনজীবি। সে হীরার লিংকম্যানের কাজ করত। পুলিশের দাবি, আজ জেরায় হীরা ও তাঁর তিন সঙ্গী দোষ স্বীকার করেছে। |
গত দুই দশকে বহু বিস্ফোরণ, ডাকাতি, অপহরণ, তোলাবাজি ও হত্যার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত হীরা শরণিয়া। আলফার সবচেয়ে নৃশংস, অথচ ঠান্ডা মাথার কম্যান্ডার তিনি। বাক্সা জেলার তামুলপুরের দীঘলিপাড় গ্রামের বাসিন্দা হীরা। ১৯৯০ সালে সে আলফায় যোগ দেয়। পুলিশের মতে, অন্য নেতাদের মতো বিদেশের মাটিতে আত্মগোপন করে নয়, অসমের বাক্সা ও নলবাড়িতে ঘাঁটি গেড়েই একের পর এক বড় অপরাধ করে গিয়েছে হীরা। এফসিআই কর্তা পি সি রামের অপহরণের ঘটনাতেও হীরার হাত ছিল। অথচ পুলিশ বা সেনাবাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে বারবার সে পালিয়ে গিয়েছে। বাক্সার এক পুলিশকর্তা জানান, “এমনও হয়েছে, হীরাকে ধরতে গ্রামে গিয়ে ছদ্মবেশী হীরাকেই হীরার হদিস জিজ্ঞাসা করে ঠকেছি আমরা।” ২০০৫ সালে সেনাবাহিনী তারপ ডেরা ঘিরে ফেলার পরেও হীরা বাইক নিয়ে পালায়। তবে তাঁর বাইকের পিছন থেকে পড়ে যায় আলফা জঙ্গি দুলাল ডেকা। তাকে গুলি করে মারেন জওয়ানরা। দুলালের ব্যাগ থেকে কয়েকটি পিস্তল, ২০ হাজার টাকা, আটটি সিম, দুটি স্যাটেলাইট ফোন ও ভুটান অভিযানের সময় হীরার হাতে লেখা ডায়েরি উদ্ধার হয়। তা থেকে আলফা সম্পর্কে অনেক তথ্য মিলেছিল। ২০১০ সালে আলফা চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়া, উপ-সেনাধ্যক্ষ রাজু বরুয়া-সহ আলফার শীর্ষ নেতারা বাংলাদেশ থেকে অসমে আসার পরে, এক সময় পরেশ বরুয়ার ঘণিষ্ঠ হীরা রাজখোয়াকে সমর্থন করে আলোচনাপন্থীদের সঙ্গেই যোগ দেয়। কার্যত বাক্সা ও নলবাড়িতে, আলোচনাপন্থী নেতা-সদস্যদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হীরাই যোগাড় করে। ২০১১ সালে আলফার প্রতিষ্ঠা দিবসে তিনসুকিয়ার কাকোপথার শিবিরে প্রথম বার ক্যামেরার সামনে আসে হীরা। তার আগে অবধি সংবাদমাধ্যমেও হীরার কোনও ছবি ছিল না। তবে আলফা কম্যান্ডার হলেও হীরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অংশ নন। আলোচনাপন্থী নেতা হলেও, তিনি অপরাধমূলক কাজকর্ম বন্ধ করেনি। পুলিশ দাবি, গত তিন মাসে গুয়াহাটিতে যত ডাকাতি ও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, তার সিংহভাগের পিছনে হীরার হাত ছিল। |