মুখে ক্ষত, পায়ে প্লাস্টার বেঁধে বিছানায় পড়ে রয়েছে চার বছরের মেয়েটি। অভিযোগ, চলন্ত অটো তাকে ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়েছে প্রায় ৩০ মিটার রাস্তা। তার মা চিৎকার করে অটো থামাতে বলছিলেন। কিন্তু অটো থামাননি চালক।
শিশুটির বাবা-মা চালকের ‘অমানবিকতা’র কথা পুলিশকে জানিয়েছিলেন শুক্রবার। অথচ, অভিযোগ পাওয়ার পরে তিন দিন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটি আসার পরে অবশেষে সোমবার গ্রেফতার করা হয়েছে অভিযুক্ত ওই চালককে। পুলিশের এই আচরণে আরও এক বার স্পষ্ট হল, শহর জুড়ে অটোচালকদের ‘দাদাগিরি’ চলছে একই রকম ভাবে। আবার প্রমাণিত হল, রাজনৈতিক দলের ‘প্রভাব’ উপেক্ষা করে অটো-রাজের বিরুদ্ধে কঠোর হতে এখনও অসহায় পুলিশ।
লোয়ার কেজি-র ছাত্রী, অদ্রিকা নামে চার বছরের ওই শিশুটির মা শর্মিষ্ঠা ঘোষাল জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার স্কুল থেকে মেয়েকে নিয়ে অটোয় চড়ে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। মেয়েকে কোলে নিয়ে সিঁথি-কুঠিঘাট রুটের অটোয় উঠেছিলেন তিনি। কিছু ক্ষণের মধ্যেই চালক জোরে অটো চালাতে শুরু করে বলে অভিযোগ শর্মিষ্ঠার। |
বাড়িতে মায়ের সঙ্গে জখম অদ্রিকা। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র |
তাঁর কথায়, “এবড়ো-খেবড়ো রাস্তার মাঝপথে অটো একটি বাঁক নিতেই কোল থেকে পড়ে গেল মেয়ে। বাঁ হাত দিয়ে কোনও মতে ওকে ধরে রয়েছি, তখন অর্ধেক দেহ রাস্তায় ঝুলছে ওর।” চিৎকার করে চালককে অটো থামাতে বলেও কোনও লাভ হয়নি বলে অভিযোগ শর্মিষ্ঠার। সহযাত্রীদের কাছ থেকেও তিনি কোনও সাহায্য পাননি বলে দাবি তাঁর। ইতিমধ্যেই মেয়ের বাঁ পা অটোর চাকায় ঘষটে গিয়েছে। হঠাৎ শর্মিষ্ঠার হাত ফস্কে অদ্রিকা ছিটকে যায় রাস্তায়। আতঙ্কিত শর্মিষ্ঠা চালকের কলার টেনে ধরতে বাধ্য হয়ে অটো থামায় সে। অটো থেকে লাফ দিয়ে শর্মিষ্ঠা যখন নামলেন, তখন প্রায় ৩০ মিটার পিছনে ক্ষতবিক্ষত শরীরে রাস্তায় পড়ে আর্ত-চিৎকার করছে অদ্রিকা। শর্মিষ্ঠার অভিযোগ, তাঁকে নামিয়ে অন্য যাত্রীদের নিয়ে চলে যান ওই অটোচালক।
স্থানীয় কয়েক জন শর্মিষ্ঠা ও অদ্রিকাকে আর একটি অটোতে তুলে আরজিকর হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে স্থানীয় একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয় অদ্রিকাকে। সেখানে তার অস্ত্রোপচার হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, অদ্রিকার বাঁ পায়ের আঘাত গুরুতর। সেই পায়ে ইস্পাতের প্লেট বসানো হয়েছে।
অটোচালকদের ‘পিছনে’ যে কোনও না কোনও ইউনিয়ন রয়েছে, সন্ধেবেলাই তার প্রমাণ পায় ঘোষাল পরিবার। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, একটি অটো নিয়ে কয়েক জন নার্সিংহোমে গিয়েছিলেন। অনীত জানান, “অটোচালকের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য ওঁরা বলতে থাকেন। তাঁদেরই এক জন বলেছিলেন, “ওই অটোচালক মাত্র কয়েক মাস ওই রুটে গাড়ি চালাচ্ছেন।” ওই অটোচালকেরা কোন ইউনিয়নের, তা অবশ্য বলতে চাননি অনীত। শুক্রবার কাশীপুর থানায় লিখিত অভিযোগ করেন তিনি।
পুলিশের দাবি, প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার শর্মিষ্ঠা যখন বাড়ি ফিরছেন, তখন বাঁ হাতে অদ্রিকাকে কোলে ধরে রেখেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে ছিল দু’টি ব্যাগ। আচমকাই তাঁর মোবাইলে একটি ফোন আসে। ডান হাত দিয়ে ফোনটি ধরার সময়ে অসাবধানতাবশত পড়ে যায় অদ্রিকা। এ দিন অদ্রিকার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পায়ে প্লাস্টার বেঁধে বিছানায় শুয়ে রয়েছে সে। বৃহস্পতিবারের ঘটনায় এতই আতঙ্কিত যে, কথা প্রায় বলতেই পারছে না। সারা শরীরে এত অসহ্য ব্যথা যে, পাশ ফিরতেও তীব্র কষ্ট হচ্ছে তার। কাঁপা-কাঁপা গলায় কোনও মতে কথা বলছে। কিন্তু কেন দেরি হল অভিযুক্ত চালক সঞ্জয় দাসকে ধরতে? পুলিশ সূত্রের খবর, যে নার্সিংহোমে চিকিৎসা হয়েছিল অদ্রিকার, তার রিপোর্ট প্রাথমিক ভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি ওই পুলিশকর্মী। সে কারণেই অদ্রিকার আঘাত যে গুরুতর, সে কথা জানতে পারেননি ওসি। ডিসি (ট্রাফিক) দিলীপকুমার আদক বলেন, “অটোচালককে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
সোমবার অদ্রিকার বাড়িতে যান রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। অটোচালকের অমানবিক আচরণের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “তৃণমূল কংগ্রেসের কেউ এ কাজ করেননি।” আজ, মঙ্গলবার সব ক’টি অটো ইউনিয়নকে তিনি বৈঠকে ডেকেছেন বলে জানালেন মন্ত্রী। সিটু-নিয়ন্ত্রিত অটোচালকদের সংগঠনের সভাপতি কিশোর ঘোষও বলেন, “চালকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা খুবই নিন্দনীয়।” রাজনীতিকেরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিন বা না দিন, অটোর দৌরাত্ম্য এখনও তাড়া করছে গোটা শহরকে। |